প্লুটোর টেনজিং মন্টেস: সৌরজগতের বরফের উঁচু পাহাড়


প্লুটোর পৃষ্ঠে এমন কিছু জিনিস দেখা গেছে, যা আমাদের সৌরজগতের অন্য কোথাও দেখা যায়নি।
এগুলো আসলে বরফের পাহাড়! শুনতে অদ্ভুত লাগছে, তাই না? কিন্তু এগুলো কোনো পাথর বা মাটির পাহাড় নয়, বরং পুরোপুরি বরফের তৈরি! তবে, এটা আমাদের পান করার মতো সাধারণ বরফ নয়। প্লুটোর চরম ঠান্ডায় ($ -232°C$ বা $ -387°F$ ), জলীয় বাষ্প বা বরফ এতটাই শক্ত হয়ে যায় যে, পাথরের মতোই আচরণ করে। তাই এই বরফের পাহাড়গুলো আমাদের পৃথিবীর গ্রানাইট বা বেসাল্টের মতোই মজবুত।
প্লুটোর সবচেয়ে উঁচু বরফের পাহাড়ের নাম হল টেনজিং মন্টেস (Tenzing Montes)। এর সর্বোচ্চ চূড়ার উচ্চতা প্রায় ৬.২ কিলোমিটার, যা আমাদের পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত এভারেস্টের (৮.৮ কিলোমিটার) চেয়ে সামান্য কম হলেও, প্লুটোর আকারের তুলনায় এটি অনেক বিশাল। ভাবো, প্লুটোর ব্যাস মাত্র ২,৩৭৬ কিলোমিটার, সেখানে ৬.২ কিলোমিটার উঁচু পাহাড় থাকাটা সত্যিই অবাক করা!
প্লুটোর পাহাড়ের চূড়ায় সাদা আস্তরণ দেখা যায়, যা দেখতে আমাদের পৃথিবীর বরফাবৃত চূড়ার মতোই। কিন্তু এখানেও রয়েছে একটি বড় পার্থক্য। পৃথিবীর পাহাড়ের চূড়ায় বরফ জমে কারণ উপরের বায়ুমণ্ডল ঠান্ডা থাকে। কিন্তু প্লুটোর ক্ষেত্রে উল্টোটা ঘটে। প্লুটোর বায়ুমণ্ডল উপরের দিকে উষ্ণ থাকে এবং সেখানে মিথেন গ্যাসের ঘনত্ব বেশি। যখন এই মিথেন গ্যাস পর্বতের চূড়ায় পৌঁছায়, তখন এটি ঠান্ডা হয়ে সাদা বরফের মতো জমে যায়।
প্লুটোর কিছু পাহাড়ের চূড়ায় বড় বড় জ্বালামুখ বা গর্ত দেখা গেছে, যা থেকে বিজ্ঞানীরা মনে করেন এগুলো ক্রায়ো-ভলকানোস (Cryovolcanoes) বা বরফের আগ্নেয়গিরি। এই আগ্নেয়গিরিগুলো থেকে লাভা বা গলিত শিলা বের হয় না, বরং তরল বাষ্পযুক্ত পানি, অ্যামোনিয়া এবং মিথেন এর মিশ্রণ উদগীরণ হয়। এটি পৃথিবীর আগ্নেয়গিরির চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন, কিন্তু একই ধরনের পর্বত তৈরি করতে পারে!
প্লুটোর এই পাহাড়গুলো তৈরি হয়েছে তুলনামূলকভাবে নতুন সময়ে অনুমান করা হয় এই পাহাড়গুলো প্রায় ১০০ মিলিয়ন বছর আগে তৈরি হয়েছে, যা সৌরজগতের ৪.৫ বিলিয়ন বছরের ইতিহাসে খুব সাম্প্রতিক ঘটনা। এর মানে, প্লুটোর ভূতাত্ত্বিক কার্যকলাপ আজও চলছে।
পাহাড়গুলো একা থাকে না, একটা সীমানার মতো আছে! প্লুটোর বিখ্যাত স্পুটনিক প্ল্যানিটিয়া (Sputnik Planitia) নামে একটি বরফের সমভূমি আছে, যা প্লুটোর হৃদয়ের আকৃতি তৈরি করে। এই সমভূমির চারপাশে, বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমে, টেনজিং মন্টেস এবং হিলারি মন্টেস নামে দুটি বিশাল বরফের পর্বতমালা আছে।
প্লুটোর তাপমাত্রা এতই কম হলেও, কিছু কিছু জায়গায় নাইট্রোজেন বরফের হিমবাহ (glacier) দেখা যায়। এই হিমবাহগুলো ধীরে ধীরে প্রবাহিত হয়ে স্পুটনিক প্ল্যানিটিয়ার সমভূমিতে মিশে যাচ্ছে। এটা অনেকটা আমাদের পৃথিবীর হিমবাহের মতো, যা পাহাড় থেকে নেমে আসে।
প্লুটোর পৃষ্ঠে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পৃথিবীর মাত্র ৬%। এর অর্থ হল, প্লুটোর পাহাড়ে আরোহণ করা পৃথিবীর তুলনায় অনেক সহজ হবে। আপনি যদি প্লুটোতে একটি পাহাড়ে লাফিয়ে উঠতে চান, তাহলে আপনি হয়তো পৃথিবীর চেয়ে অনেক বেশি উপরে লাফ দিতে পারবেন!
প্লুটোর কিছু পর্বতের গায়ে অদ্ভুত কিছু খাঁজ বা ফাটল দেখা যায়। এই খাঁজগুলোকে বিজ্ঞানীরা পেনিটেন্টস (Penitentes) নামে চেনেন। এগুলো আসলে বরফের তৈরি তীক্ষ্ণ স্তম্ভের মতো কাঠামো। প্লুটোতে এগুলো অনেক বড়, প্রায় ৫০০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে!
এতদিন প্লুটোকে একটি হিমশীতল, নিষ্ক্রিয় জগৎ মনে করা হত। কিন্তু এই বরফের পাহাড়, আগ্নেয়গিরি এবং হিমবাহের আবিষ্কার প্রমাণ করেছে যে প্লুটোর অভ্যন্তরে তাপ উৎপন্ন হয় এবং সেখানে ভূতাত্ত্বিক কার্যকলাপ চলে।
দৈএনকে/জে .আ
