বিচার ও আইনের শাসন প্রশ্নে ধানমন্ডির ঘটনা


আইনের শাসন কেবল সংবিধানের পাতায় সীমাবদ্ধ একটি শব্দ নয়; এটি একটি রাষ্ট্রের ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতীক। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ঘটনাটি আবারও সেই প্রশ্ন সামনে এনেছে, আইন কি সবার জন্য সমান, নাকি এর প্রয়োগ নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা উদ্দেশ্যের সুবিধার্থে পরিবর্তিত হয়?
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়া এক সাধারণ রিকশাচালক আজিজুর রহমান, হঠাৎ গণপিটুনির শিকার হয়ে পুলিশের হাতে আটক হলেন। পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে এক বছর আগের হত্যাচেষ্টা মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ আনা হয়। যদিও সেই মামলার প্রকৃতি ছিল রাজনৈতিক আন্দোলনকেন্দ্রিক এবং তখনকার পরিস্থিতির জটিলতায় একাধিক নাম ‘সন্দেহভাজন আসামি’ হিসেবে উল্লেখিত হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, একজন দিনমজুর, জীবিকার জন্য রিকশা চালানো মানুষ, সত্যিই কি এমন একটি মামলার অংশীদার হতে পারেন? নাকি তিনি কেবল পরিস্থিতির শিকার?
অন্তর্বর্তী সরকারের বিবৃতিতে স্পষ্ট করা হয়েছে যে, গ্রেফতারের যথাযথ ভিত্তি সম্পর্কে ব্যাখ্যা চাইতে হয়েছে ধানমন্ডি থানার ওসির কাছে। একইসঙ্গে তার কর্মকাণ্ডে কোনো অসঙ্গতি আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে ঢাকা মহানগর পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে দেশে একটি প্রবণতা তৈরি হয়েছিল যেখানে ‘সন্দেহভাজন’ শব্দটি যেনো নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। কারও বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারযোগ্য অভিযোগ থাকলেই সহজে মামলায় নাম জড়িয়ে দেওয়া হতো।
আজিজুর রহমানের ঘটনা তাই কেবল একজন রিকশাচালকের গ্রেফতার নয়, বরং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জবাবদিহি প্রশ্নের প্রতিফলন। আদালতের ভূমিকা এখানে উল্লেখযোগ্য। জামিনের সিদ্ধান্ত প্রমাণ করেছে যে, অন্তত বিচার বিভাগের অংশ এখনও মানবিক বিবেচনায় আইনকে ব্যাখ্যা করতে পারে।
কিন্তু বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে, এ ঘটনার মাধ্যমে দুটি বিষয় আমাদের ভাবতে হবে। প্রথমত, গণপিটুনি সংস্কৃতি। কোনো প্রমাণ ছাড়াই জনতার হাতে একজন মানুষ লাঞ্ছিত হওয়া আমাদের সমাজে ভয়ঙ্কর অস্থিরতার প্রতিচ্ছবি। দ্বিতীয়ত, আইনের অপপ্রয়োগ ও সন্দেহভাজন ধারা। কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তার সুষ্ঠু তদন্ত হতে হবে, কিন্তু ‘সন্দেহভাজন’ আখ্যায়িত করে গ্রেফতার করা মানবাধিকার ও আইনের শাসনের পরিপন্থী।
আজিজুরের ঘটনা আমাদের সতর্ক করে দিচ্ছে যে, ন্যায়বিচারের মানদণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করলে রাষ্ট্র তার নৈতিক ভিত্তি হারাতে বসে। অন্তর্বর্তী সরকারের দৃঢ় অবস্থান তাই একটি আশাব্যঞ্জক দিক। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, পুলিশ কর্মকর্তারাও নয়।
আজ আমাদের মনে রাখতে হবে, একটি রিকশাচালকের প্রতি অন্যায় মানে গোটা সমাজের প্রতি অন্যায়। ন্যায়বিচারের পাল্লা সামান্যতম বেঁকে গেলে তা শেষ পর্যন্ত গোটা রাষ্ট্রকাঠামোকেই অস্থিতিশীল করে তোলে। তাই এ ঘটনার দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্ত এবং যথাযথ জবাবদিহিই হতে পারে সবার আস্থা ফিরিয়ে আনার একমাত্র উপায়।
