নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান: সম্ভাবনার দ্বার খুলছে বাংলাদেশ


দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সূচনা ঘটেছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্বাচনী ঘোষণা দিয়ে। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট ঘোষণা জাতীয় জীবনে এক গভীর অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়েছে। ফলে সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে এক ধরনের নির্বাচনী উচ্ছ্বাস, তৈরি হয়েছে আশাবাদের আবহ। রাজনীতির মাঠ যেমন প্রস্তুতির ব্যস্ততায় জমজমাট হয়ে উঠছে, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসন, এমনকি সাধারণ জনগণের মধ্যেও স্বস্তি ও প্রত্যাশার সূচনা ঘটেছে।
গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে যে অস্থিরতা ও প্রতিহিংসার রাজনীতি আমরা দেখে আসছি, সেই প্রেক্ষাপটে এই নির্বাচন সময়ের এক বাস্তব প্রয়োজন। দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জর্জরিত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পুনরুজ্জীবনের জন্য নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন একটি ন্যূনতম শর্ত। ফলে নির্বাচন ঘিরে নানা রাজনৈতিক দল, বিশেষত বিএনপি, জামায়াত, গণসংহতি আন্দোলন, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি প্রভৃতি দলগুলোর পক্ষ থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া এই ঘোষণার গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ প্রশাসনের অঙ্গীকার, নিরাপত্তা বাহিনীর প্রশিক্ষণ, এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে দীর্ঘদিন ওএসডি থাকা কর্মকর্তাদের পদোন্নতি এবং নিরপেক্ষভাবে এসপি ও ওসিদের পদায়নের সিদ্ধান্ত এসব অঙ্গীকারের বাস্তবায়নের ইঙ্গিত বহন করে। নির্বাচন কমিশনও যথাযথ প্রস্তুতি নিচ্ছে, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সীমানা পুনর্নির্ধারণ, দল নিবন্ধন প্রক্রিয়া এগুলো নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে সহায়ক হবে।
অন্যদিকে, ব্যবসায়ীদের স্বস্তি এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ এই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বহির্প্রকাশ। রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান হলে অর্থনীতিও স্থিতিশীল হবে, এটি প্রমাণিত সত্য। ফলে নির্বাচনের ঘোষণা শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রেই নয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের পথেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।
তবে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ বাকি। নির্বাচন যে অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ হবে, তা নিশ্চিত করতে হবে বাস্তব কর্মপন্থার মাধ্যমে। শুধু ঘোষণায় নয়, আচার-আচরণ, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা, রাজনৈতিক সহনশীলতা ও সহিংসতামুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করেই এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন সম্ভব। সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি না হলে নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক থেকেই যাবে, যার ফলাফল হবে রাজনৈতিক অস্থিরতা।
গণতন্ত্র শুধু নির্বাচনেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি একটি পদ্ধতি, যার প্রতিটি স্তরে রয়েছে জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, সহনশীলতা ও জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। এই নির্বাচনী প্রক্রিয়া সে লক্ষ্যে একটি পদক্ষেপ হতে পারে, যদি তা সঠিকভাবে পরিচালিত হয়।
সর্বোপরি, বাংলাদেশের জনগণ এখন একটি বিশ্বাসযোগ্য, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের অপেক্ষায় আছে। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠিত এই অন্তর্বর্তী সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত দায়িত্ব হবে এই নির্বাচনকে এমন এক মডেল হিসেবে উপস্থাপন করা, যা ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথকে সুগম করবে। এখন সময় দায়িত্বশীলতার, সহনশীলতার এবং দেশকে একটি স্থিতিশীল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নেওয়ার।
