চারটি প্রাণ, একসাথে বিদায়


রাজশাহীর পবা উপজেলার সেই ঘরটি আজ মৃত নীরবতায় ঢাকা। একসময় যেখানে ভাতের হাঁড়ি থেকে ধোঁয়া উঠত, শিশুর হাসি গুঁজন করত, রাতের আঁধারে স্বামী-স্ত্রী মিলে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনত, আজ সেখানে শুধু এক হিম শূন্যতা।
ভোরের আলো জানালায় এসে লুটিয়ে পড়েছিল, কিন্তু ঘরের ভেতরে কোনো আলো ঢোকেনি। এক কোণে বাবার দেহ দুলছে ঝুলন্ত অবস্থায়, যেন জীবনের সমস্ত যুদ্ধ শেষ করে তিনি গলায় ফাঁস দিয়ে শেষ আশ্রয় নিয়েছেন। আরেক ঘরে স্ত্রীর নিথর শরীর, কিশোর ছেলের স্থির চোখ, আর দেড় বছরের নিষ্পাপ কন্যার চিরঘুম, যে ঘুম আর কোনোদিন ভাঙবে না।
টেবিলে রাখা একখানা কাগজ, আমরা মরে গেলাম ঋণের বোঝা নিয়ে আর খাওয়ার অভাবে… চিরদিনের জন্য চলে গেলাম। আমি চাই সবাই ভালো থাকবেন।
শব্দগুলো যেন রক্তমাখা ছুরি, নরম কাগজে খোদাই হয়ে আছে অগণিত রাতের কান্না, অপমান আর নিরাশার ভার। ঋণের বোঝা, অভাবের তীব্রতা, আর ভবিষ্যতের ভয়ের কাছে জীবনের আলো নিভে গেছে।
এ শুধু একটি পরিবারের গল্প নয়, এ আমাদের সমাজের গল্প। এই দেশে হাজারো মিনারুল আছে, যারা প্রতিদিন বাজারের আগুন, সুদের শিকল আর আয়ের অনিশ্চয়তার সঙ্গে যুদ্ধ করছে। যারা হাসি লুকিয়ে রাখে, কান্না গোপন করে, আর কোনো একদিন নীরবে ভেঙে পড়ে।
আমরা কোথায় ছিলাম? কেন শুনতে পাইনি তাদের সাহায্যের নীরব আহ্বান? হয়তো আমাদের কান আছে, কিন্তু শোনার অভ্যাস নেই; চোখ আছে, কিন্তু দেখার সাহস নেই।
এই মৃত্যুর দায় কেবল একজন মানুষের সিদ্ধান্তে সীমাবদ্ধ নয়। দায় আছে রাষ্ট্রের, যে সুরক্ষার ছাতা মেলে দিতে পারেনি। দায় আছে সমাজের, যা সহমর্মিতার হাত বাড়াতে ভুলে গেছে। দায় আছে আমাদের, যারা চারপাশের মানুষের কষ্টকে এড়িয়ে চলেছি।
এখনও সময় আছে, ঋণের ফাঁদ ভাঙার জন্য কঠোর আইন দরকার, যাতে কোনো পরিবার সুদের বোঝায় শেষ হয়ে না যায়। মানসিক স্বাস্থ্যসেবার দরজা খুলে দিতে হবে, যাতে লজ্জা আর ভয় পেরিয়ে মানুষ সাহায্য চাইতে পারে। জরুরি সহায়তার ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে বিপদে পড়া পরিবার জীবন থেকে পালানোর কথা না ভাবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের শিখতে হবে আবার মানুষের দিকে তাকানো, মন দিয়ে শোনা, পাশে দাঁড়ানো।
মিনারুল ও তার পরিবারের জীবন নিভে গেছে, যেন চারটি প্রদীপ একসাথে নিবে গেলো। কিন্তু এই আলো নেভার মুহূর্ত যদি আমাদের হৃদয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়, তবে হয়তো আর কোনো ঘর চিরদিনের মতো অন্ধকারে ডুবে যাবে না। জীবন ঋণের কাছে হার মানে না, আমাদের দায়িত্ব এই সত্যকে বাঁচিয়ে রাখা।
