সাতক্ষীরায় কুষ্ঠরোগে বাড়ছে সচেতনতা, কমছে ভয়ের সংস্কার


সাতক্ষীরায় কুষ্ঠরোগ নিয়ে ভয়ের সংস্কার ভাঙছে, বাড়ছে সচেতনতা। আগে যেখানে রোগীকে সমাজে একঘরে করা হতো, এখন মানুষ নিজে থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন।
সাতক্ষীরা শহরের মেহেরুন্নেসা (ছদ্মনাম, ৩৮) বলেন, “চামড়ায় প্রথম দাগটা উঠেছিল তিন বছর আগে। গায়ে জ্বর, শরীর ব্যথা, হাত-পায়ের অনুভূতি হারিয়ে ফেলি। চিমটি কাটলেও বুঝতাম না কিছু।” প্রথমে স্থানীয় চিকিৎসক একে সাধারণ চর্মরোগ ভেবে চিকিৎসা দেন। পরে ভারতের এক চিকিৎসকের পরামর্শে জানা যায়, তিনি কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত।
তিনি বলেন, “চিকিৎসা নিতে লজ্জা পাইনি, কিন্তু সমাজের অবহেলাই সবচেয়ে কষ্ট দিয়েছে। প্রতিবেশীরা আমার সঙ্গে খেতে চাইত না, আমি যে পুকুরে গোসল করতাম সেখানে আর কেউ নামত না।”
এমন অভিজ্ঞতা সাতক্ষীরা পৌরসভার কুখরালি এলাকার রহিমা খাতুনের (ছদ্মনাম, ৪৫)ও। দেরিতে রোগ ধরা পড়ায় তাঁর দুই হাতে দশটি ও পায়ে তিনটি আঙুল কেটে ফেলতে হয়েছে। এখন তিনি নিয়মিত ওষুধ খান এবং বলেন, “মানুষ এখন আর আগের মতো দূরে সরে যায় না।”
বেসরকারি সংস্থা সিএসএস (খ্রিষ্টান সার্ভিস সোসাইটি)-এর তথ্য অনুযায়ী, সাতক্ষীরায় ২০১৯ সালে কেবল ২ জন কুষ্ঠরোগী শনাক্ত হলেও ২০২৪ সালে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৮ জনে। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে ৩৫ জন। বর্তমানে জেলায় চিকিৎসাধীন আছেন ৫১ জন—এর মধ্যে কালীগঞ্জে ৩৯, আশাশুনিতে ১১ এবং সদরে একজন।
জেলা কুষ্ঠ ও টিবি নজরদারি কর্মকর্তা ডা. মো. ইব্রাহিম হাওলাদার বলেন, “আগে মানুষ কুষ্ঠরোগী দেখলেই ভয় পেত, এখন আর তা নেই। প্রচারণা ও সচেতনতা কার্যক্রম বাড়ায় কুসংস্কার অনেকটাই কমেছে।” তিনি জানান, কালীগঞ্জ ও আশাশুনিতে শনাক্তের হার বেশি কারণ সেখানে সংস্থাগুলোর কার্যক্রম জোরদার।
কুষ্ঠ মাইকোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রাই নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়। মুখ ও নাকের নিঃসৃত ড্রপলেটের মাধ্যমে এটি ছড়াতে পারে, তবে সাধারণ ছোঁয়া, হাত মেলানো বা একসঙ্গে খাওয়ায় নয়। চিকিৎসা শুরু করলেই সংক্রমণ বন্ধ হয়ে যায়।
সিএসএস ও দ্য লেপ্রসি মিশন বাংলাদেশ-এর সহযোগিতায় সরকার এখন প্রতিটি উপজেলায় বিনামূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসা দিচ্ছে। সিএসএসের প্রজেক্ট অফিসার মো. খালেকুজ্জামান বলেন, “আমরা প্রতিটি উপজেলায় সচেতনতা কার্যক্রম চালাচ্ছি, রোগীরা এখন দ্রুত চিকিৎসা নিচ্ছেন।”
জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. আব্দুস সালাম বলেন, “কুষ্ঠ এখন আর ভয় পাওয়ার মতো রোগ নয়—এটি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। পর্যাপ্ত ওষুধ মজুদ রয়েছে এবং প্রতিটি রোগী নজরদারিতে রয়েছে। আমাদের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে কুষ্ঠরোগ শূন্যে নামিয়ে আনা।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে প্রতি বছর গড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার নতুন কুষ্ঠরোগী শনাক্ত হন। বিশেষজ্ঞদের মতে, আশাব্যঞ্জক বিষয় হলো—আগের তুলনায় রোগ শনাক্তের হার বাড়লেও ভয় কমেছে, সচেতনতা বেড়েছে।
“এখন মানুষ কুষ্ঠকে ভয় নয়, রোগ হিসেবে দেখছে—এটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য।”
