ক্ষুধার্ত শিশু আমিরকে ত্রাণ কেন্দ্রে গিয়েই গুলি করলো ইসরায়েল


খাবারের আশায় খালি পায়ে ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছিল গাজার এক ক্ষুধার্ত শিশু, নাম তার আমির। গায়ে ছিল ছেঁড়া পোশাক, চোখে ছিল এক চিলতে আশার ঝিলিক। সে গিয়েছিল গ্লোবাল হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)-এর একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে, সামান্য কিছু খাবার সংগ্রহের আশায়। কিন্তু সেই আশার আলো নিভে গেল সহিংস বাস্তবতায়—ত্রাণ সংগ্রহের পরপরই ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারায় এই নিঃস্ব শিশুটি।
বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) ঠিক এমনই এই হৃদয়বিদারক ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেন যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য ও জিএইচএফের সাবেক চুক্তিভিত্তিক কর্মী অ্যান্থনি অ্যাগুইলার। ইসরায়েলি মানবাধিকারকর্মী অফির গুটেলজন এবং সাংবাদিক নোগা টারনোপলস্কির সঙ্গে ‘আনএক্সপেক্টবল’ পডকাস্টে এই ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি।
অ্যাগুইলার বলেন, আমির আমার কাছে এসে হাত বাড়িয়ে দেয়। আমি তাকে ডাকি, সে আমার হাত ধরে চুমু খায় আর বলে, শুকরান (ধন্যবাদ)। তবে এই আবেগঘন মুহূর্তের স্থায়িত্ব ছিল খুবই অল্প সময়। এরপরই শুরু হয় মরাগ করিডোরে ত্রাণ নিতে আসা মানুষের ওপর পিপার স্প্রে, টিয়ার গ্যাস, স্টান গ্রেনেড ও গুলির বর্ষণ।
ছোট ছোট শিশু, নারী, পুরুষ যারা তখনো আশপাশে ছিল, তাদের ওপর গুলি চালানো হয়। আমি শুনতে পাই মেশিনগানের শব্দ। চারপাশে মানুষ মাটিতে পড়ে যাচ্ছ, নিহত হচ্ছে, বলেন অ্যাগুইলার।
তার ভাষ্য অনুযায়ী, আমির ১২ কিলোমিটার পথ হেঁটে এসে সামান্য কিছু খাবার পেয়েছিল। আমাদের ধন্যবাদ জানিয়েছিল, আর তারপর মারা যায়।
মার্কিন কংগ্রেসে নিন্দা, আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স একটি ভিডিও পোস্ট করে বলেন, আমাদের করদাতাদের অর্থে এমন নৃশংসতা চালানো হচ্ছে।
ফ্রান্সের পররাষ্ট্র ও ইউরোপীয় বিষয়ক মন্ত্রী জঁ-নোয়েল ব্যারো এই বিতরণ পদ্ধতির কড়া সমালোচনা করে বলেন, গাজায় জিএইচএফের পরিচালনায় ত্রাণ কার্যক্রমে রক্তস্রোত বয়ে গেছে। তিনি এটিকে ‘লজ্জাজনক’ ও অবিলম্বে বন্ধ করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন।
চলতি বছরের মে মাসের শেষদিকে গাজায় জাতিসংঘ-সমর্থিত পূর্ববর্তী ব্যবস্থার বদলে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত বিতর্কিত ত্রাণ বিতরণ সংস্থা জিএইচএফের কার্যক্রম শুরু হয়। নতুন এই পদ্ধতিতে গাজাবাসীদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ত্রাণ নিতে যেতে হয়।
ইসরায়েল দাবি করে, এই পদ্ধতিতে হামাসের হাতে ত্রাণ চলে যাওয়ার আশঙ্কা কম। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) সাম্প্রতিক এক অভ্যন্তরীণ বিশ্লেষণে হামাসের মাধ্যমে বড় আকারে ত্রাণ চুরি হওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি, ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তারাও নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, হামাস ত্রাণ ছিনিয়ে নিচ্ছে- এমন কোনো প্রমাণ নেই।
জিএইচএফ যদিও অ্যাগুইলারকে ‘অসদাচরণে বরখাস্ত’ হওয়া এক অসন্তুষ্ট কর্মী হিসেবে অভিহিত করেছে। তবে তার বক্তব্য আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। জিএইচএফের দাবি, অ্যাগুইলার তাদের কাছে পুনরায় চাকরি চেয়েছিলেন ও প্রতিশোধমূলক হুমকিও দিয়েছিলেন।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধের পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৬০ হাজার ২৪৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। জিএইচএফের বিতরণ পদ্ধতি শুরুর পর থেকে এক হাজারেরও বেশি মানুষ ত্রাণ সংগ্রহের সময় নিহত হয়েছেন। তার মধ্যে শুধু বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) ভোর থেকে কমপক্ষে ১৫ জন ত্রাণপ্রার্থী নিহত হয়েছেন।
এদিকে, জাতিসংঘ হুঁশিয়ার করেছে, গাজায় ত্রাণ প্রবাহ ভয়াবহভাবে অপ্রতুল। তীব্র দুর্ভিক্ষের মধ্যে এখন পর্যন্ত অনাহারে ১৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে ৮৯ জনই শিশু। সঙ্কটাপন্ন এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ইসরায়েল অবশেষে জিএইচএফ ছাড়াও অন্যান্য সংস্থাকে ত্রাণ বিতরণের অনুমতি দিয়েছে। তবে মানবিক দুর্যোগ এখনো অব্যাহত।
