ব্যয়বহুল মেট্রোরেলে নিরাপত্তাঝুঁকি : দায় কার?

ঢাকার মেট্রোরেল বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নের এক মাইলফলক প্রকল্প। এটি শুধু একটি পরিবহনব্যবস্থা নয়’ এটি আধুনিক নগর ব্যবস্থাপনার প্রতীক, যা নাগরিকদের মধ্যে নতুন আশা জাগিয়েছিল। কিন্তু ফার্মগেটে মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে এক পথচারীর মৃত্যু সেই আশাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। এক বছর আগেও একই স্থানে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। অথচ যথাযথ প্রতিকার বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, এটাই সবচেয়ে উদ্বেগজনক।
প্রায় ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকায় নির্মিত মেট্রোরেল প্রকল্পটি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল অবকাঠামো উদ্যোগগুলোর একটি। প্রতি কিলোমিটার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা, যা প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। এত ব্যয়বহুল প্রকল্পে যদি নকশাগত ত্রুটি, নির্মাণজনিত ত্রুটি বা মান নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি থাকে তাহলে সেটি কেবল অব্যবস্থাপনা নয়, বরং রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় ও জননিরাপত্তার প্রতি চরম উদাসীনতার শামিল।
মেট্রোরেল থেকে ১২০ থেকে ১৫০ কেজি ওজনের বিয়ারিং প্যাড পড়ে একজন মানুষের মৃত্যু কোনো ‘দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা’ নয়; এটি নকশা, তত্ত্বাবধান ও গুণগত মান নিয়ন্ত্রণে গলদ থাকার স্পষ্ট ইঙ্গিত। এ ধরনের দুর্ঘটনা উন্নত দেশগুলোয় বিরল, কারণ সেখানে প্রতিটি নির্মাণ উপাদান বহুমাত্রিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অনুমোদিত হয়। অথচ আমাদের এখানে আগেরবার একই ঘটনা ঘটার পরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এটি কেবল মেট্রোরেলের যাত্রীদের জন্য নয়, এর নিচে চলা লাখো পথচারীর জন্যও এক অব্যাহত হুমকি।
ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা বারবার তদন্তের কথা বলছেন, কিন্তু আগের তদন্তের ফলাফল জনগণের সামনে প্রকাশ হয়নি। দায় এড়ানোর এই প্রবণতা থামাতে হবে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, ঠিকাদার ও তত্ত্বাবধায়ক সংস্থার মধ্যে কার অবহেলায় এই দুর্ঘটনা ঘটেছে তা নিরপেক্ষভাবে নির্ধারণ করতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, এটি “কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাপস”। অর্থাৎ যেখানে প্রযুক্তিগত দক্ষতা, পরিকল্পনা ও গুণগত নিশ্চয়তার সমন্বয় প্রয়োজন ছিল, সেখানে হয়েছে অবহেলা ও অদক্ষতার প্রভাব। এমন অবহেলার দায় কেবল স্থানীয় প্রকৌশলীরা নয়, বিদেশি পরামর্শক সংস্থাগুলোকেও নিতে হবে। তারা প্রকল্পের জন্য কোটি কোটি টাকা পরামর্শ ফি নিয়েছে তাহলে দায়ও তাদের নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের প্রস্তাবিত ‘রেসকিউ অডিট’ এখন সময়ের দাবি। পুরো লাইনজুড়ে, বিশেষ করে বাঁক ও উচ্চতা পরিবর্তনযুক্ত এলাকাগুলোতে, প্রতিটি পিলার ও বিয়ারিং প্যাড পুনঃনিরীক্ষণ করতে হবে। একই সঙ্গে মেট্রোরেলের পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ম্যানুয়াল পুনর্বিবেচনা জরুরি, কারণ ভবিষ্যতে আরও বড় দুর্ঘটনা ঠেকাতে এটি এখনই করতে হবে।
মেট্রোরেল কেবল প্রযুক্তি নয়, এটি নাগরিক আস্থার প্রতীক। কিন্তু এই ধরনের দুর্ঘটনা যদি বারবার ঘটে, তবে সাধারণ মানুষ মেট্রোরেলের নিচে হাঁটতেও ভয় পাবে, ট্রেনে চড়ার আস্থাও হারাবে। এমন বাস্তবতা কোনোভাবেই একটি আধুনিক নগরীর জন্য কাম্য নয়।
সর্বপরি, রাষ্ট্রের অর্থে গড়ে ওঠা এই ব্যয়বহুল প্রকল্পে যদি নকশাগত ত্রুটি, দুর্বল গুণগত মান বা প্রশাসনিক গাফিলতি প্রমাণিত হয় তবে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, পদ-মর্যাদা নির্বিশেষে। একই সঙ্গে মেট্রোরেলের প্রতিটি অংশে নিরাপত্তা যাচাই সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত কঠোর তদারকি জারি রাখতে হবে।
ঢাকার নাগরিকদের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। মেট্রোরেল আমাদের গর্বের প্রকল্প, এটিকে অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার প্রতীকে পরিণত হতে দেওয়া যাবে না।