রবিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৫
Natun Kagoj

ডেঙ্গু কেন রোধ করা যাচ্ছে না, এবং আমাদের দায়িত্ব কী?

ডেঙ্গু কেন রোধ করা যাচ্ছে না, এবং আমাদের দায়িত্ব কী?
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

ঢাকার শিশু হাসপাতালে এই মুহূর্তে ২১ জন শিশু ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে ইকবাল হোসেন পাটোয়ারীর আট বছরের সন্তান ও বেসরকারি চাকরিজীবী জাহাঙ্গীর আলমের সন্তান রয়েছেন। দুই অভিভাবকই দিনরাত একাকার করে সন্তানের সুস্থতার জন্য চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাদের ক্ষোভের সুরে যে প্রশ্নটা উঠে আসে, তা ভেঙে দেয় কেবল ব্যক্তিগত দায়িত্বের ধারণা নয়, বরং বৃহত্তর জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভঙ্গুরতা: ‘মশা মারতে না পারলে আমরা কেনো কর দেবো?’

ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতি চোখে পড়ার মতো। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুমের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে মোট ১৬ হাজার ২৯৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এসময় ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ২৫৯ জনের। এই সংখ্যা শুধু alarming নয়, বরং নির্দেশ করে যে, ডেঙ্গু রোধের জন্য বাস্তবায়নযোগ্য কার্যক্রম যথেষ্ট কার্যকর হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা একমত, ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশা নিয়ন্ত্রণই সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার। তবে এখানেই বড় সমস্যার সূচনা। রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ তারেক হাসান শিমুল বলেন, আমাদের নিজের ঘর-বাড়ি, আশেপাশের এলাকা ও শহরের ড্রেন পর্যন্ত পরিষ্কার না রাখলে কোনো সরকারি প্রচেষ্টা সফল হবে না। এডিস মশা তিন দিনের বেশি পানি জমে থাকা পাত্রেই জন্মায়। কিন্তু আমরা নিজে সচেতন না হলে, স্প্রে বা ওষুধের কার্যকারিতা সীমিত।

সরকারও চেষ্টা করছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ জানিয়েছেন, মশা নিধন ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চলছে, তবে সমস্যা হলো জনসাধারণের সম্পৃক্ততা। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ শুধুমাত্র সরকারের একার দায়িত্ব নয়; এটি একটি সম্মিলিত উদ্যোগ। যদি প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ বাড়ি ও আশেপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব পালন না করে, তাহলে ডেঙ্গু ও মশার সংক্রমণ বাড়তেই থাকবে।

ডেঙ্গুর ভয়াবহতার পেছনে আরও কিছু কারণ রয়েছে। যেমন ভাইরাসের নতুন ধরন, যা সংক্রমণের মাত্রা ও জটিলতা বাড়াচ্ছে। পাশাপাশি আমাদের জনসচেতনতার অভাব। মশার আবাস ক্রমেই বাড়ছে, যা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণকে আরও কঠিন করছে। বরগুনার উদাহরণ দেখলেই বোঝা যায়, পানি সংগ্রহের ড্রাম বা ট্যাঙ্কও মশার জন্মস্থান হয়ে যাচ্ছে। ঢাকনা থাকলেও পানি ব্যবহারের সময় মশা ঢুকে বংশবিস্তার করছে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে কিছু সুস্পষ্ট বাস্তবিক দিক আমাদের মনে রাখতে হবে:

* জনসচেতনতা: প্রত্যেক মানুষকে নিজ নিজ ঘর, বারান্দা, ছাদ ও আশেপাশের এলাকা পরিষ্কার রাখতে হবে।

* পানি জমতে দেবেন না: তিন দিনের বেশি পানি জমে থাকা মানেই মশার প্রজননস্থল।

* মশা নিধন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ: সরকারি স্প্রে ও কার্যক্রমের সাথে নিজ উদ্যোগ জুড়ে দিন।

* সচেতন স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ: জ্বর বা সন্দেহ হলে দ্রুত পরীক্ষা এবং প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি।

ডেঙ্গু রোধের কাজ শুধুমাত্র স্প্রে বা ওষুধের ওপর নির্ভর করে না। এটি আমাদের জীবন-শৈলীর সঙ্গে সম্পর্কিত। সরকারের প্রচেষ্টা যদি জনগণের সচেতনতার সঙ্গে মিলিত হয়, তখনই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন সচেতনতা, নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা, এবং স্থানীয় সরকার ও নাগরিকদের সম্মিলিত উদ্যোগ।

ইকবাল হোসেন পাটোয়ারী ও জাহাঙ্গীর আলমের মতো অভিভাবকরা যখন নিজেদের সন্তানকে বাঁচানোর জন্য লড়াই করছেন, তখন আমাদের সবারও দায়িত্ব বেড়ে যায়। শুধুমাত্র অভিযোগ করা যথেষ্ট নয়, কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মশার কামড় থেকে বাঁচতে না পারলে, স্বাস্থ্যসেবা কতই না উন্নত হোক, জীবন হুমকির মধ্যে থাকবে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে এটাই সময় যে, আমরা সকলে একযোগে সচেতন হই, এবং নিজের ঘর, এলাকা ও শহরকে মশামুক্ত করার দায়িত্ব গ্রহণ করি। অন্যথায়, প্রতিবারের মতোই আমরা আক্রান্ত ও মৃত্যুর তালিকায় শুধুই সংখ্যার বৃদ্ধি দেখব, আর সংকট আরও গভীর হবে।


গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

আরও পড়ুন