রবিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৫
Natun Kagoj

রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞের বিচার: শেখ হাসিনা–কামাল মামলার সত্যিকার চিত্র

রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞের বিচার: শেখ হাসিনা–কামাল মামলার সত্যিকার চিত্র
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

গত বছরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। দীর্ঘদিন ক্ষমতার চূড়ায় থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এরপর তার বিরুদ্ধে দায়ের হয় অসংখ্য মামলা। এর মধ্যে একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ সংক্রান্ত মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল–১-এ বিচারাধীন, যেখানে শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনও আসামি।

প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে, জুলাই–আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় শান্তিপূর্ণ ছাত্র আন্দোলন দমন, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে হত্যাকাণ্ড, গুম ও দুর্নীতি, পুলিশের ছোড়া গুলি, আনসার–বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততা এবং লাশ পুড়িয়ে ফেলা, হেলিকপ্টার, বোম্বিংসহ অন্যান্য নৃশংসতা। এই মামলায় ২৮ কার্যদিবসে ৫৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক শেষ হয়েছে। স্টেট ডিফেন্সের যুক্তিতর্ক শেষ হলেই রায়ের তারিখ নির্ধারণ করবেন ট্রাইব্যুনাল।

শেখ হাসিনার এ মামলায় মোট ৮৪ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এর মধ্যে চাক্ষুষ সাক্ষী সাতজন, আহত ভুক্তভোগী দুজন, ভুক্তভোগীর পরিবারের আটজন, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সাতজন, আহতদের চিকিৎসক তিনজন, জব্দ তালিকার সাক্ষী ১৪ জন এবং সাংবাদিক, ময়নাতদন্তকারী, রাজসাক্ষী, বিশেষ তদন্তকারী ও মূল তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে একজন করে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এছাড়া ম্যাজিস্ট্রেট, বিশেষজ্ঞ, ওয়্যারলেস বার্তার সাক্ষী হিসেবে একজন করে এবং ফরেনসিক ও ঘটনার পটভূমির সাক্ষী হিসেবে দুজন জবানবন্দি দিয়েছেন।

সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় ৩ আগস্ট। প্রথম সাক্ষী হিসেবে ট্রাইব্যুনালে ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টের বীভৎসতার চিত্র তুলে ধরেন খোকন চন্দ্র বর্মণ। বাঁ চোখ নষ্ট এবং নাক–মুখ বিকৃত হলেও ২৩ বছর বয়সী এই তরুণ দৃঢ়ভাবে নিজের জবানবন্দি দেন। ৮ অক্টোবর মূল তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীরের জেরার মাধ্যমে শেষ হয় মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের ধাপ, যেখানে তিনি ছিলেন ৫৪তম সাক্ষী। বিশেষভাবে আলোচিত ছিলেন ৪৬ নম্বর সাক্ষী আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, যিনি জুলাই–আগস্টের গণহত্যাসহ গত ১৬ বছরের গুম–খুনের বর্ণনা দেন। তার পরেই জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এবং লেখক ও গবেষক বদরুদ্দীন উমরের দেওয়া জবানবন্দি ট্রাইব্যুনালে গৃহীত হয়। ৩৬ নম্বর রাজসাক্ষী চৌধুরী মামুন আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৬ বছরের শাসনামলের অজানা তথ্য উন্মোচন করেন এবং একই সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে আদালতের কাছে আবেদন করেন।

প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে দালিলিক প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে ৯০টি তথ্যচিত্র, ৩৫টি বস্তুগত প্রমাণ, তৎকালীন সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্তপত্র, গুলির নির্দেশনা, অডিও–ভিডিওসহ বিভিন্ন নথিপত্র। চারটি ফোনালাপের অডিও রেকর্ড বাজিয়ে শোনানো হয়, যেখানে শেখ হাসিনা–শেখ ফজলে নূর তাপস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি মাকসুদ কামাল এবং জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে হাসিনার কথোপকথনে জুলাই–আগস্ট আন্দোলন দমনের নীলনকশা, নৃশংসতা ও হত্যার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সাক্ষীদের জবানবন্দিতেও এসব বিষয় স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।

১৬ অক্টোবর পর্যন্ত টানা পাঁচ দিনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ সাজা চেয়েছেন। তিনি শেখ হাসিনাকে সব অপরাধীর ‘প্রাণভোমরা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তবে রাজসাক্ষী হিসেবে তথ্য প্রদান করা মামুনের শাস্তি আদালতের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। প্রসিকিউশনের মতে, জুলাই–আগস্টে সংঘটিত ঘটনা ছিল বিস্তৃত ও পদ্ধতিগত অপরাধ, যা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী crimes against humanity হিসেবে চিহ্নিতযোগ্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ নির্দেশ ও নেতৃত্বেই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এসব হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়। পুলিশ, বিজিবি, আনসার, গোয়েন্দা সংস্থা ও পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে শান্তিপূর্ণ ছাত্র আন্দোলন দমন করা হয়, যাতে ১৪০০–এরও বেশি মানুষ নিহত এবং হাজারো মানুষ আহত হন।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, শেখ হাসিনা ও কামাল, কারও ক্ষেত্রেই mitigating factor নেই। প্রধান আসামি শেখ হাসিনা ছিলেন অপরাধের nucleus। এতসব অপরাধের পরও তার কোনো অনুশোচনা নেই। উল্টো, তিনি ‘hard–nut criminal’ হিসেবে আচরণ করছেন। কমান্ড স্ট্রাকচারে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন আসাদুজ্জামান খান কামাল। তাই তাদের ব্যাপারে চরম দণ্ড চাওয়া হয়েছে। সাবেক আইজিপি মামুন রাজসাক্ষী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করেছেন, যা আদালতের বিবেচনায়।

মামলার কার্যক্রম এখনো চলমান। চলতি সপ্তাহে স্টেট ডিফেন্স আইনজীবীর যুক্তিতর্ক ও প্রসিকিউশনের খণ্ডনের পর রায়ের দিন ধার্য হবে। অন্যদিকে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে শেখ হাসিনা ও কামালের খালাস সম্ভব। তার বক্তব্য, আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করতে যা প্রয়োজন ছিল, তাই করা হয়েছে; কোনো ঢালাও বা অতিরঞ্জিত নির্দেশ দেওয়া হয়নি।

শেখ হাসিনার পতনের পর গত বছরের ১৪ আগস্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের হয়। দুই মাস পর তদন্ত শুরু হয়। তদন্তে প্রধান ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে শেখ হাসিনার নাম উঠে আসে। ১২ মে তদন্ত সংস্থা প্রতিবেদন জমা দেয় এবং এরপর ট্রাইব্যুনাল–১–এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়। দুই ধাপে শুনানি শেষে ১০ জুলাই আদালত আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগের পৃষ্ঠাসংখ্যা ৮,৭৪৭, যার মধ্যে তথ্যসূত্র, জব্দ তালিকা, দালিলিক প্রমাণ এবং শহীদদের তালিকা অন্তর্ভুক্ত।

এই মামলা শুধুমাত্র এক বা দুইজন উচ্চপদস্থ নেতার বিচার নয়’ এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবাধিকার ও রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতার একটি ঐতিহাসিক নজির। রায় দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, গণঅভ্যুত্থানের প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ শাসন ব্যবস্থার ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে। এটি প্রমাণ করবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ ও গণনির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার অপরিহার্য, এবং ক্ষমতার অপব্যবহার কখনোই অপরাধের আশ্রয় হতে পারে না।


গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

আরও পড়ুন