ইসলামের দৃষ্টিতে মব সন্ত্রাস গর্হিত অপরাধ


যখন জনতা নিজেরাই বিচারক হয়ে ওঠে, তখন সমাজে আইনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ‘মব লিঞ্চিং’ বা গণপিটুনির প্রতিটি দৃশ্য কেবল সহিংসতা নয়, এটি আইনের শাসনের উপর সরাসরি আঘাত। ধর্ম, গুজব বা আবেগ—এই বাহানাগুলো একের পর এক প্রাণ নিচ্ছে। আমরা কি তবে সত্যিই হারিয়ে ফেলেছি সহানুভূতি, যুক্তি ও ন্যায়বোধ?
এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের জানা উচিত যে, ইসলাম এই বিষয়ে কী বলে? কোনো অপরাধের বিচার কি জনতা নিজ হাতে নিতে পারে? ইসলামে এই বিষয়ে অবস্থান একেবারেই সুস্পষ্ট, শক্ত এবং মানবিক।ইসলামে মব সন্ত্রাস সম্পূর্ণরূপে হারাম ও অন্যায়।
অন্যায়ের প্রতিকারে অন্যায় নয়
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَىٰ أَلَّا تَعْدِلُوا ۚ اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَىٰ
‘কোনো জাতির প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে ইনসাফ না করার প্রবণতায় টেনে না নেয়। ইনসাফ করো—এটাই তাকওয়ার কাছাকাছি।’
(সুরা আল-মায়িদা, আয়াত : ৮)
এই আয়াত সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, কাউকে দোষী মনে করলেও তার প্রতি জুলুম করা যাবে না।
গণপিটুনি বা মব সন্ত্রাস মূলত এমন এক কুপ্রবণতা যেখানে বিচারের আগে দণ্ড দেওয়া হয়। অথচ ইসলামে অপরাধ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে অপরাধী ঘোষণা করা হারাম।
প্রমাণ ছাড়া দণ্ড দেওয়া নিষিদ্ধ অপরাধ
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
لو يُعْطَى الناسُ بدَعْوَاهُم، لادَّعى رجالٌ دِماءَ قومٍ وأموالَهم، ولكنِ اليمينُ على المدَّعى عليهِ.
‘যদি লোকেরা কেবল অভিযোগ করলেই তাদের দাবি মেনে নেওয়া হতো, তাহলে মানুষ অন্যদের রক্ত ও সম্পদ দাবি করত। বরং প্রমাণ থাকা চাই।’
(মুসলিম, হাদিস : ১৩৮)
তাহলে, যে সমাজে অভিযোগ করলেই গায়ে হাত তোলা হয়, সেখানে ইসলামের সুবিচার নেই, আছে জাহিলিয়াত। প্রমাণ ছাড়া কাউকে মারধর করা শুধু অন্যায় নয়, ইসলামে তা গর্হিত পাপ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বটে।
শাস্তির ভার রাষ্ট্রের, ব্যক্তির নয়
ইসলামী বিচারব্যবস্থায় শাস্তি দেওয়ার অধিকার একমাত্র বিচারক বা হাকিমের। ব্যক্তি বা জনতা সেই ক্ষমতা রাখে না। ইমাম নববী (রহ.) বলেন:
“الحدود لا تقام إلا بإمام أو نائبه”
‘হুদুদ বা শরিয়ত নির্ধারিত শাস্তি কেবল শাসক বা তার প্রতিনিধি দিতে পারে।’
(আল-মাজমু', ২০/৪৩)
অর্থাৎ শরিয়তের দৃষ্টিতে অপরাধীর শাস্তিও নির্ধারিত নিয়মে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মাধ্যমে হতে হবে, জনতার হুজুগে নয়।
নিরপরাধকে মারার পরিণতি জাহান্নাম
মব সন্ত্রাসের বড় বিপদ হলো, এতে অসত্য গুজবে নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারায়। কোরআনুল কারীমে মহান আল্লাহ বলেন:
مَنْ قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا
‘যে ব্যক্তি কোনো মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে, সে যেন সমস্ত মানবজাতিকে হত্যা করল।’
(সূরা মায়িদা, আয়াত : ৩২)
মহানবী (সা.) বলেন:
لزوالُ الدنيا أهونُ على الله من قتلِ رجلٍ مسلمٍ بغيرِ حقٍّ
‘পৃথিবী ধ্বংস হওয়া আল্লাহর কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ, কোনো নিরপরাধ মুসলমানের খুনের চেয়ে।’
(সুনান আন-নাসায়ী, হাদীস: ৩৯৮৭)
তাহলে, মব সন্ত্রাস মানেই এমন এক অপরাধ যার জন্য কিয়ামতের দিন ভয়াবহ শাস্তি অপেক্ষা করছে।
মব প্রতিরোধে জনসচেতনতা ও সামাজিক দায়িত্ব
রাসূল (সা.) বলেন:
انْصُرْ أَخَاكَ ظَالِمًا أَوْ مَظْلُومًا
‘ তুমি তোমার ভাইকে জালিম বা মাজলুম উভয় অবস্থায় সাহায্য করো’
সাহাবিরা বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল, মজলুম হলে তো তাকে সাহায্য করব। কিন্তু যালিম হলে কিভাবে?”
জবাবে তিনি বললেন:
تَحْجُزُهُ أَوْ تَمْنَعُهُ مِنَ الظُّلْمِ فَإِنَّ ذَلِكَ نَصْرُهُ
‘তাকে অন্যায় থেকে বিরত রাখো, এটিই তার প্রতি সাহায্য।’
(বুখারী, হাদিস : ২৪৪৪)
তাই, যখন কেউ মব সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়তে চায়, তখন তাকে নিবৃত্ত করা, বিষয়টির সমাধানে তার সঙ্গে কথা বলা, যেকোনো উপায়ে তাকে থামিয়ে দেওয়া। এগুলোই অপর মুসলিম ভাইকে প্রকৃত সাহায্য, এগুলোই ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা।
কারণ মব সন্ত্রাস কখনো ইসলাম সমর্থন করে না। বরং এটি একটি জাহিলিয়াতপূর্ণ হিংস্র প্রবণতা, যা ইসলামের সুবিচার, দয়া ও ইনসাফমূলক সমাজব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত। মুসলিমদের উচিত, আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়া এবং সমাজে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সচেতন নাগরিক হিসেবে নববী আদর্শের আলোকে অপর ভাইকে সাহায্যের ভূমিকা পালন করা।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সহিহ বুঝ দান করুন।
দৈএনকে/ জে. আ
