হার না মানা আরাফাতের সংগ্রামের গল্প


কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার এক ছোট্ট গ্রামে জন্ম নেওয়া আরাফাত আহমেদ রুপকের শিক্ষাজীবনের সংগ্রাম ও অধ্যবসায় সত্যিই অনুপ্রেরণার এক অসাধারণ গল্প। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় ভীতু ছিলেন আরাফাত। এমনকি দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলে যাওয়ার সময় মা ছাড়া একা থাকতে পারতেন না। একবার গণিতে মাত্র চার নম্বর পাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল তার জন্য বড় এক হতাশার কারণ।
পিএসসি পরীক্ষায় মাত্র ৩.০০ পয়েন্ট নিয়ে তিনি উলিপুর এমএস স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি হন। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনায় খুব সিরিয়াস ছিলেন না, তবে জেএসসি পরীক্ষায় ৩.৩৬ পয়েন্ট পাওয়ার পর তার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও স্কুলের শিক্ষকদের পক্ষ থেকে ‘তুমি পারবে না, নেয়ার দরকার নেই’ বলে হতাশাজনক মন্তব্য পেয়ে তিনি মনোবল হারাননি।
জোর করে সায়েন্স বিভাগে ভর্তি হয়ে প্রথমে উচ্চতর গণিতে সাহস না পেয়ে কৃষি শাখায় পড়াশোনা শুরু করেন, পরে উচ্চতর গণিতে মনোযোগ দেন এবং অধ্যয়ন শুরু করেন। এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল সত্ত্বেও কিছু বিষয়ে কম নম্বর পাওয়ার কারণে চূড়ান্ত ফলাফলে মাত্র ৪.৫৬ পয়েন্ট পান, যা ‘এ+’ এর নিচে। এই সময়ে চারপাশ থেকে নানা নেতিবাচক মন্তব্য শুনতে হয়েছে—“তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না।”
তবে তাঁর বাবা সবসময় পাশে দাঁড়িয়ে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। বাবার মুখ থেকে শুনেছেন, “চেষ্টা করো, তোমার কোন ঘাটতি থাকবে না।” এই কথাগুলো আরাফাতের মনোবলকে আরো দৃঢ় করেছে। ভালো কলেজে ভর্তি হতে না পারলেও গ্রামের কলেজেই ভর্তি হয়ে নিয়মিত পড়াশোনা চালিয়ে যান। অনলাইনের মাধ্যমে বন্ধুদের পরামর্শ নিয়ে আরও মনোযোগ দিয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন। তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি ও গণিতের প্রস্তুতি অনেকটাই শেষ করে প্রথমবারের মতো এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫.০০ অর্জন করেন।
এরপর খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (মিস্ট) – এ ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন। ফলাফল হিসেবে তিনি বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ৪৪১তম স্থান লাভ করেন।
ফলাফল প্রকাশের রাতটা আরাফাত ও তার পরিবারের জন্য এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত ছিল। আনন্দে কেঁদে ফেলেন সবাই। এই সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রাখেন তার বাবা।
আরাফাত সাংবাদিকদের বলেন, “বাবার ‘চেষ্টা করো’ কথাগুলো ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রেরণা। কঠোর পরিশ্রম আর ধৈর্য থাকলেই যেকোনো বাধা জয় করা সম্ভব।”
আরাফাতের বাবা সাংবাদিকদের, জানান “আমি সবসময় তাকে বলেছি, তুমি চেষ্টা করো, কেউ তোমাকে থামাতে পারবে না। তার অধ্যবসায় আজকের সফলতার মূল চাবিকাঠি।” তার স্থানীয় শিক্ষকরাও আরাফাতের প্রতি গর্ব প্রকাশ করে বলেন, “তার অধ্যবসায়, মনোযোগ ও সংকল্প শিক্ষার্থীদের জন্য এক অনুপ্রেরণা। আমরা আশা করি সে দেশ ও সমাজের জন্য গর্বের নাম হবে।”
স্থানীয় মানুষরাও আনন্দ প্রকাশ করে বলেন, “আমাদের গ্রামের সন্তান এমন সাফল্য অর্জন করেছে, যা আমাদের জন্য গর্বের। সে সকল শিক্ষার্থীকে নতুন উদ্যম ও অনুপ্রেরণা দেবে।”
অবশেষে আরাফাত তাঁর জুনিয়রদের জন্য বার্তা দেন, “বেসিক বিষয়গুলো ভালোভাবে শিখতে হবে, নিয়মিত অনুশীলন করতে হবে, সময় নষ্ট না করে পরিশ্রম করতে হবে। সফলতা আসবেই।”
আরাফাতের এই শিক্ষাজীবনের সংগ্রাম ও সাফল্যের গল্প প্রমাণ করে, সংকল্প, অধ্যবসায় ও পরিশ্রম থাকলে যেকোনো পরিস্থিতি জয় করা সম্ভব।
