প্রাণের তিন কর্মীর কারাদণ্ড, কোম্পানির দাবি ‘পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’


পাবনার চাটমোহরে প্রাণ ডেইরি হাব সেন্টারে ভেজাল দুধ জব্দ ও বিপুল রাসায়নিক দ্রব্য উদ্ধার ঘটনায় প্রাণ কোম্পানির তিন কর্মীকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। একদিকে প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার দাবি এটি সুসংগঠিত খাদ্য ভেজালের চক্র, অন্যদিকে প্রাণ গ্রুপের দাবি এটি কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বী সরবরাহকারীদের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র।
জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) দীর্ঘদিন নজরদারির পর ২১ জুলাই চাটমোহরের ছাইকোলা প্রাণ ডিপো এবং উপজেলার লাঙ্গলমোরা গ্রামে দিনব্যাপী অভিযান চালায়।
অভিযানে নেতৃত্ব দেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুসা নাসের চৌধুরী। সেখানে প্রায় ৩ হাজার লিটার ভেজাল দুধ, প্রচুর রাসায়নিক পদার্থ (সোডা, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, সয়াবিন তেল, পাউডার, আঠা ইত্যাদি) এবং উৎপাদন সরঞ্জাম জব্দ করা হয়।
ভ্রাম্যমাণ আদালত যে তিন প্রাণ কর্মীকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন, তারা হলেন, শামসুল আলম (৩৬), এরিয়া ম্যানেজার, ফরিদপুর, জহির রায়হান (২৭), সিরাজগঞ্জ, নাজমুল হোসাইন (৩৫), সাঁথিয়া। এছাড়া স্থানীয় ছয়জনকে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিকসহ আটক করে থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
এনএসআই’র পাবনা উপপরিচালক তৌফিক ইকবাল বলেন, প্রাণের স্থানীয় কর্মকর্তা ও অসাধু ব্যবসায়ীরা যোগসাজশে বিষাক্ত রাসায়নিক মিশিয়ে দুধ তৈরি করছিল। এগুলো বিভিন্ন সংগ্রহ কেন্দ্রে পাঠিয়ে সারা দেশে বিক্রি করা হচ্ছিল, যা সরাসরি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা বাড্ডায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এটি আমাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। স্থানীয় ভেজাল দুধ সরবরাহকারী একটি চক্র নিম্নমানের দুধ সরবরাহে ব্যর্থ হয়ে আমাদের কয়েকজন কর্মীকে হাত করে ডিটারজেন্ট মেশানো দুধ সংগ্রহ কেন্দ্রে ঢুকিয়েছে। পরে প্রশাসনকে খবর দিয়ে ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে, যাতে কোম্পানির সুনাম নষ্ট হয়।
তিনি দাবি করেন, প্রাণ ডেইরিতে চার ধাপে দুধের গুণগত মান পরীক্ষা হয় এবং খারাপ দুধ পাওয়া গেলে তা নষ্ট করা হয়। গত এক বছরে মান যাচাইয়ে ব্যর্থ হওয়ায় ২৭ লাখ লিটার দুধ ফেরত দেওয়া হয়েছে, ২৮৩ জন সরবরাহকারীকে ব্লক করা হয়েছে এবং ২৭ জন কর্মীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
প্রাণ ডেইরির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা মাকসুদুর রহমান আরও বলেন, এই চক্র আমাদের কর্মকর্তাদের আগেও হুমকি দিয়েছে, এমনকি গত মার্চে এক কর্মকর্তাকে মারধর করেছে।
খাদ্য নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, দুধে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ও সোডা মেশালে তা দুধকে অস্থায়ীভাবে সাদা ও ঘন রাখে, কিন্তু এগুলো মানুষের পাকস্থলী, লিভার ও কিডনির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। শিশুদের ক্ষেত্রে এটি দীর্ঘমেয়াদে অপুষ্টি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস এবং ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।
বর্তমান খাদ্য নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী, ভেজাল খাদ্য উৎপাদন, মজুত বা বিপণনের শাস্তি সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড। তবে এই ঘটনায় ভ্রাম্যমাণ আদালত মাত্র ৬ মাসের সাজা দিয়েছেন, যা অনেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ।
আইনবিদদের মতে, এত বড় ঘটনার ক্ষেত্রে বিচারিক তদন্ত ও অপরাধমূলক মামলা হওয়া উচিত, যাতে মূল হোতারা শনাক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, প্রাণের মতো বড় ব্র্যান্ডের নামে ভেজাল দুধের ঘটনা তাদের হতাশ করেছে। কেউ কেউ মনে করেন, কোম্পানির দায় থাক বা না থাক, গুণগত মান নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
ঘটনার দুই বিপরীত বক্তব্য,একদিকে প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার অভিযোগ, অন্যদিকে কোম্পানির ষড়যন্ত্র দাবি এখন একটি পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি তুলেছে খাদ্য নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলো।
