এলজিইডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাবেদ করিমের দুর্নীতির সাম্রাজ্য


স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সড়ক ও সেতু রক্ষণাবেক্ষণ ইউনিট) জাবেদ করিমের বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিস্ময়কর অভিযোগ উঠেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তিনি শুধু নিজের নামে নয়, স্ত্রীর নামেও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে তুলেছেন শত শত কোটি টাকার সম্পদের সাম্রাজ্য। অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি দীর্ঘদিন ধরে ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে এই টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছেন।
রাজধানীর গুলশান ১-এর ১৩০ নম্বর সড়কে আমারি ওয়ে ডেভেলপার্স লিমিটেডের পাশেই রয়েছে জাবেদের মালিকানাধীন একটি বিশাল গ্যারেজ, যার আয়তন ৩০ কাঠা এবং বাজারমূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এছাড়া বনানীর ২৫/এ সড়কের ৫৫ নম্বর বাড়ির নির্মাণে খরচ হয়েছে আরও প্রায় শত কোটি টাকা।
প্রগতি সরণির শহিদ আব্দুল আজিজ রোডে ৩০ কাঠার একটি প্লট কিনে সেখানে ভাড়া দিয়েছেন “পেইন টেকিং অটোমোবাইলস” নামে গ্যারেজ।
এছাড়াও মিরপুর, উত্তরা, আফতাবনগর, বসুন্ধরা, ঝিলমিল আবাসিক, কেরানীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে তার ও তার স্ত্রীর নামে একাধিক প্লট, ফ্ল্যাট ও বাড়ি। এসব সম্পদের বাজারমূল্য হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
সম্পদের মধ্যে রয়েছে, নিজের নামে গুলশান ৩০ কাঠার গ্যারেজ, যার বাজার মূল্য ১০০ কোটি টাকা, বনানী ২৫/এ বাড়ী, যার বাজার মূল্য ৯৫ কোটির টাকার বেশি, উত্তরা ফ্ল্যাট (৩২০০ বর্গফুট), যার বাজার মূল্য ৫.২ কোটি টাকা, গাজীপুর বাড়ি, যার বাজার মূল্য ১২.৬০ কোটি টাকা, নারায়ণগঞ্জ বাড়ি মূল্য ৬.৫ কোটি টাকা, কেরানীগঞ্জ ফ্ল্যাট মূল্য ১.২ কোটি টাকা, স্ত্রীর নামে বসুন্ধরা (ডি ব্লক) ৬৯ নম্বর প্লট, যার বাজার মূল্য ৪০ কোটি টাকা, পূর্বাচল ৬৫ নম্বর প্লট বাজার মূল্য ১০.৫ কোটি টাকা, আফতাবনগর ৯৮ নম্বর প্লট, মূল্য ১০.৬ কোটি টাকা, ঝিলমিলে প্লটের দাম ২.৯ কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জাবেদ করিমের দুর্নীতির প্রধান সহযোগী ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রীর এপিএস মো. জাহিদ হোসেন চৌধুরী। তারা মিলে গড়ে তুলেছিলেন একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, এলজিইডিতে প্রকল্প পরিচালক কিংবা জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী নিয়োগে পদভেদে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুষ আদায় করা হতো।
বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে জাবেদ সিন্ডিকেট ঢাকার আগারগাঁও, মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে চলতেন। সরকারি প্রকল্পে বরাদ্দ বণ্টন, পদায়ন, বদলি, সবকিছুতেই চলত টাকার খেলা।
জানা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে অভাবনীয়ভাবে অর্থ ও ক্ষমতা লাভ করলেও, বর্তমানে নিজেকে বিএনপি পরিবারের সদস্য হিসেবে পরিচয় দিয়ে পরিস্থিতি অনুকূলে রাখার চেষ্টা করছেন জাবেদ করিম।
অভিযোগ রয়েছে, ২০২৪ সালের শেষ দিকে সরকার পতনের আগমুহূর্তে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে ‘জাবেদ সিন্ডিকেট’ হাসিনার ব্যক্তিগত তহবিলে কোটি কোটি টাকা অনুদান দিতেন। এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে নিজেদের অবৈধ কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন তারা।
মুন্সীগঞ্জে নির্বাহী প্রকৌশলী থাকাকালীন প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পে ২% হারে ঘুষ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে জাবেদের বিরুদ্ধে। তৎকালীন সময়ে তার নামে ১ লাখ ২৮ হাজার ৫৪৯ টাকার অডিট আপত্তিও ওঠে।
পরবর্তীতে, বহুমুখী দুর্যোগ আশ্রয়কেন্দ্র প্রকল্পের (MDRSP) পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে শত কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠে।
রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা মো. আরমান হোসেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবর জাবেদ করিমের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। সেই অভিযোগপত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে অনুসন্ধানে উঠে আসে তার বিপুল অবৈধ সম্পদের বিবরণ।
এলজিইডির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, জাবেদ করিমের আমলে বদলি, পদায়ন এবং প্রকল্প অনুমোদন, সবকিছুই ছিল ‘দালালি ও কমিশনের খেলায়’ পরিণত।
বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার জাবেদ করিমের সঙ্গে ফোন ও সরাসরি অফিসে যোগাযোগ করা হলেও তার কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
