বাস্তুতন্ত্রে হাতির গুরুত্ব অপরিসীম


বাস্তুতন্ত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী হাতি। প্রতি বছর ১২ই আগস্ট পালিত হয় হাতি দিবস। এই দিবসটি হাতিদের সংরক্ষণ এবং সুরক্ষার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য উৎসর্গীকৃত। বিশ্বজুড়ে হাতির সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় তাদের আবাসস্থল রক্ষা এবং চোরাচালান রোধে জনসচেতনতা তৈরি করা এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য।
কানাডার দুই চলচ্চিত্র নির্মাতা প্যাট্রিসিয়া সিমস, মাইকেল ক্লার্ক এবং থাইল্যান্ডের রিইন্ট্রোডাকশন ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে মূলত বিশ্ব হাতি দিবস পালন করা সম্ভব হয়েছে। এই দিবস উৎসর্গ করা হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের হাতির সুরক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য। বন্যহাতি এবং বন্দী-হাতি উভয়ের সুরক্ষার জন্য জনসচেতনতা তৈরি করা এই দিবসের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। ২০১২ সাল থেকে ১২ আগস্ট দিনটি পালিত হয়ে আসছে।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফির মতে, গত ৭৫ বছরে হাতির সংখ্যা আনুমানিক ৫০ শতাংশ কমে গেছে। এই মুহূর্তে সারাবিশ্বে আনুমানিক ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার এশিয়ান হাতি অবশিষ্ট রয়েছে। এই হাতির সংখ্যা যেন ভবিষ্যতে আর কমে না যায় তার জন্যই প্রতিবছর পালন করা হয় বিশ্ব হাতি দিবস।
বাঘ-সিংহের পর যে প্রাণীটির কথা সবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে তা হলো হাতি। হাতিরা অত্যন্ত সামাজিক ও বুদ্ধিমান প্রাণী। তারা মানুষের মতোই সহানুভূতি, দয়া ও পরার্থপরতা প্রকাশ করে। হাতি মানুষের যোগাযোগ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে। কুকুরের পর যদি কোনও প্রাণী মানুষের সব থেকে ভালো বন্ধু হয়ে উঠতে পারে, সে হলো হাতি। হাতির ব্যবহার যেমন মিষ্টি তেমন হাতির স্মৃতিশক্তিও তুখোড়।
জীবজগতের বৃহত্তম স্থলচর স্তন্যপায়ী প্রাণী এটি। হাতির দুটি প্রজাতি আফ্রিকান হাতি এবং এশিয়ান হাতি। এই দুটি প্রজাতিরই অস্তিত্ব বর্তমানে হুমকির মুখে রয়েছে। আফ্রিকান হাতি শিকার এবং হাতির দাঁতের জন্য অবৈধ বাণিজ্যের শিকার হচ্ছে। অন্যদিকে, এশিয়ান হাতি তাদের বাসস্থানের সংকোচন, কৃষিক্ষেত্রের সম্প্রসারণ এবং অবৈধ বাণিজ্যের কারণে বিপদে আছে। হাতিদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে, আর এর প্রভাব পুরো বাস্তুতন্ত্রে পড়ছে। বাস্তুতন্ত্রে হাতির গুরুত্ব অপরিসীম।
পৃথিবীতে এশিয়ান হাতি এবং আফ্রিকান হাতি এখন এই দুই ধরনের হাতি দেখা যায়। আফ্রিকান হাতিদের পুরুষ এবং মহিলা উভয়েরই দাঁত থাকে। এশিয়ান হাতির মধ্যে কেবল পুরুষ হাতিরই দাঁত আছে। হাতি ১২ বছর বয়সে সন্তান প্রসব করতে পারে। হাতির গর্ভকাল দীর্ঘতম, প্রায় ২২ মাস। হাতি ৬০-৭০ বছর বাঁচে। কারণ এদের জীবদ্দশায় ছয়বার কষদাঁত বের হয়, আবার চিবিয়ে চিবিয়ে ক্ষয়ে যায়। কষদাঁতের শেষ সেট ষষ্ঠম দশকে গজায়, যা ক্ষয়ে যাবার পর অনাহারে মৃত্যু অনিবার্য।
হাতিরা তৃণভূমিতে বাস করে। প্রায় সব দেশেই এদের দেখা মেলে, তবে আফ্রিকার দেশগুলোতে হাতির সংখ্যা বেশি। বন উজাড়, খনির পরিমাণ বৃদ্ধি এবং কৃষিকাজের কারণে বিশেষ করে এশিয়ান হাতিদের জন্য আবাসস্থলের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। আবাসস্থলের খণ্ডিতকরণও বিচ্ছিন্নতা তৈরির কারণে হাতির প্রজনন আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। আবাসস্থল ধ্বংস হওয়ায় শিকারীদের হাতি খুঁজে পেতে এবং আরও সহজে ফাঁদ পেতে হাতি শিকার করছে। এশিয়ান হাতিরা তাদের আবাসস্থলের প্রায় ৩০-৪০ ভাগ হারিয়েছে, যার ফলে তাদের সন্তানদের এবং নিজেদের রক্ষণাবেক্ষণ করা অবিশ্বাস্যভাবে কঠিন হয়ে পড়েছে।
চিড়িয়াখানা, সার্কাস এবং পর্যটনে হাতির যত্ন এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত আইনের অভাব দেখা যায়। প্রায়শই তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করে পরিচালিত করে। বন্দীদশা হাতির জন্য একটি গুরুতর হুমকি হতে পারে। এশিয়ান হাতিদের প্রায়শই অবৈধভাবে বন্য অঞ্চলে বন্দী করা হয় এবং লাভজনক পর্যটন শিল্পে পাচার ও ব্যবহার করা হয়। যুগ যুগ ধরে বিশ্বব্যাপী বাহন আর খেলা দেখানোর দায়িত্ব পালন করা হাতিরা এখন খুব বিপদে আছে।
২০১৫ সালে বন মন্ত্রণালয় তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, যে বাংলাদেশের বনাঞ্চলে ২৮৬টি এবং চিড়িয়াখানা বা সাফারি পার্কে আরও ৯৬টি হাতি রয়েছে। সংস্থাটির ২০১৬ সালের সমীক্ষা অনুসারে, এ সংখ্যা কমে সে বছর বাংলাদেশে হাতির সংখ্যা দাঁড়ায় ২৬৮টিতে। অথচ বর্তমানে বাংলাদেশে হাতির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০০টিরও কম।
দেশের বন বিভাগের তথ্য মতে, ২০০৪ থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত গত ১৭ বছরে মানুষের হাতে হত্যার শিকার হয়েছে ১১৮টি হাতি। এদিকে বেসরকারি সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, ২০২১-২২ সালে বিভিন্ন ঘটনায় ৩৪টি হাতি মারা গেছে। যদিও বন বিভাগের রেকর্ডে এ সংখ্যা মাত্র ১৬টি। অপরদিকে গত পাঁচ বছরে সারা দেশে কমপক্ষে ৫০টি হাতি হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি সংস্থাগুলো।
হাতির চোরা শিকারই জীবজগতের বৃহত্তম স্থলচর প্রাণীটির প্রধান শত্রু। কালোবাজারে হাতির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়। বাড়ি, অফিস সাজাতে, কেউ বা শখ করে সংগ্রহ করেন হাতির দাঁতসহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রতঙ্গ। গত একযুগে সারা বিশ্ব থেকে হাতি কমেছে ৬২ ভাগ। নগরায়ণ এবং বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণেই হাতির জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রতি বছর যে হারে হাতি কমছে, তাতে আগামীতে চিড়িয়াখানা ছাড়া আর কোথাও এই প্রাণীর অস্তিত্ব থাকবে না।
মানুষ-হাতি সংঘাত একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগের বিষয়, কারণ মানুষের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং বনভূমি হ্রাস পায়, যার ফলে হাতিরা মানব বসতির কাছাকাছি চলে যায়। ঘটনার মধ্যে রয়েছে ফসলের ক্ষতি এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি, সেইসাথে হাতি এবং মানুষের হতাহতের ঘটনা।
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা হাতি নিধন ও চোরাশিকার কমাতে না পারলে হাতিও ডাইনোসরের মতো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এ জন্য হাতি সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। আর এসব বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতেই হাতির দিবসের প্রচলন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
