স্বর্ণের ব্যবহার আজ সাজের বাইরেও—প্রযুক্তি থেকে মহাকাশে


চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বলতায় মোহিত করে যে ধাতু, তা শুধু একখণ্ড ধাতু নয়, এ এক ইতিহাস, এক ঐতিহ্য, এক অনুভবের নাম স্বর্ণ। আদি সভ্যতা থেকে আধুনিক প্রযুক্তি, যেখানে মানুষের সৃজনশীলতা, চাহিদা ও মর্যাদা মিলেছে, সেখানেই জায়গা করে নিয়েছে এই মূল্যবান ধাতুটি।
রাজাদের রাজমুকুটে, বিবাহের আঙুলে, অলিম্পিক বিজয়ীর গলায়, আবার মহাকাশযানে, কম্পিউটারের সার্কিটেও সবখানে একটিই নাম বারবার উঠে আসে স্বর্ণ।
মানবজাতির সভ্যতায় এমন আর কোনো ধাতু নেই, যার ব্যবহার এত বিস্তৃত, যার প্রতি মানুষের ভালোবাসা এত পুরোনো এবং যার প্রয়োজনীয়তা আজও এত অপরিহার্য।
স্বর্ণের প্রতি মানুষের চিরন্তন মোহ
সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষ স্বর্ণকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। প্রাচীন মিসর, ভারত, চীন, গ্রিক সভ্যতা থেকে শুরু করে ইনকা, অ্যাজটেক কিংবা রোমানদের ইতিহাসেও স্বর্ণের ছাপ অমলিন। দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসীরা যখন স্প্যানিশ অভিযাত্রীদের মুখোমুখি হয়, তখন উভয় সংস্কৃতির এক জায়গায় মিল ছিল-স্বর্ণের প্রতি শ্রদ্ধা।
মানব ইতিহাসের প্রায় প্রতিটি গঠিত সমাজ স্বর্ণকে শক্তি, সৌন্দর্য, বিশুদ্ধতা ও সাফল্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছে। এই ধাতু শুধু একটি ধাতু নয় এটি এক সামাজিক মানদণ্ড, এক চেতনা।
অলংকার: চিরায়ত ও বৃহত্তম ব্যবহার
বিশ্বজুড়ে নতুনভাবে উত্তোলিত স্বর্ণের প্রায় ৫০ শতাংশ যায় অলংকার তৈরিতে। পুরাতন অলংকার রিসাইকেল করেও নতুন গহনা তৈরি হয়, যার ফলে প্রতিবছর প্রায় ৭৮ শতাংশ স্বর্ণ অলংকার শিল্পে ব্যবহৃত হয়।
স্বর্ণের উচ্চ উজ্জ্বলতা, মরিচা না পড়া, কাঁটা বা পাতলা চাদরে পরিণত করার সহজ গুণ এটিকে অলংকার তৈরিতে আদর্শ করে তুলেছে। পাশাপাশি, ঐতিহ্যগত বিশ্বাস- যেমন বিয়ের আংটি, জন্মদিনের উপহার, কিংবা সামাজিক মর্যাদার প্রতীক এই সকলেই স্বর্ণকে করেছে ‘অবধারিত’ উপাদান।
ক্যারেট, সংমিশ্রণ ও রঙের বৈচিত্র্য
বিশুদ্ধ স্বর্ণ (২৪ ক্যারেট) খুব নরম হওয়ায় এটি দৈনন্দিন ব্যবহারে টেকসই নয়। তাই স্বর্ণকে মিশিয়ে তৈরি করা হয় ২২, ২১, ১৮, ১৪ এবং ১২ ক্যারটের স্বর্ণ, যেখানে অন্যান্য ধাতু যেমন তামা, রূপা বা প্যালাডিয়াম ব্যবহার করা হয়।
এই মিশ্রণের ফলে স্বর্ণের রঙেও আসে বৈচিত্র্য
- হলুদ স্বর্ণ: স্বর্ণ + রূপা + তামা
- গোলাপি/লাল স্বর্ণ: বেশি তামার উপস্থিতি
- সাদা স্বর্ণ: স্বর্ণ + প্যালাডিয়াম
- সবুজ ও কালো স্বর্ণও তৈরি হয় বিশেষ মিশ্রণে
প্রযুক্তির রূপান্তরে স্বর্ণ
একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিভিত্তিক সমাজে স্বর্ণের ব্যবহার শুধু সৌন্দর্যে সীমাবদ্ধ নেই। মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, টিভি, ক্যামেরা এমনকি ডিজিটাল ঘড়িতেও থাকে স্বর্ণের অংশ।
বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১০০ কোটির বেশি মোবাইল ফোন উৎপাদিত হয়, যার প্রতিটিতে গড়ে থাকে প্রায় ৫০ সেন্ট মূল্যের স্বর্ণ। কিন্তু এসব ফোনের বেশিরভাগই পুনর্ব্যবহৃত হয় না, ফলে সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মূল্যবান স্বর্ণের বিরাট অংশ।
কম্পিউটার ও সার্কিটে নির্ভরযোগ্যতা মানেই স্বর্ণ
একটি কম্পিউটারের মাদারবোর্ড, প্রসেসর সংযোগ, মেমোরি কার্ড স্লট-সবখানেই থাকে স্বর্ণ। কারণ ডিজিটাল ডেটা নির্ভুলভাবে চলাচলের জন্য চাই এমন এক পরিবাহী, যার উপর নির্ভর করা যায়। স্বর্ণের সেই নির্ভরযোগ্যতা অন্য কোনো ধাতু দিতে পারে না।
দাঁতের চিকিৎসা: জং পড়ে না, শরীরেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই
স্বর্ণ দাঁতের চিকিৎসায়ও একটি আদর্শ উপাদান। ফিলিং, ব্রিজ, ক্রাউন এমনকি দাঁতের জোড়ায়ও স্বর্ণ ব্যবহৃত হয়। ইতিহাস জানায়, খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ সালে ইতালির ইট্রাসকানরা স্বর্ণ তারের মাধ্যমে দাঁত প্রতিস্থাপন করত। আজও, উচ্চমূল্য সত্ত্বেও, স্বর্ণ ব্যবহৃত হচ্ছে কারণ- এটি রাসায়নিকভাবে নিষ্ক্রিয়, অ্যালার্জি সৃষ্টি করে না, সহজে আকৃতি দেয়া যায়।
চিকিৎসাক্ষেত্রে স্বর্ণের সূক্ষ্ম ব্যবহার
স্বর্ণের ব্যবহারের আরও সূক্ষ্ম ও উচ্চ প্রযুক্তিভিত্তিক দিক রয়েছে চিকিৎসাবিজ্ঞানে:
- রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস: সোডিয়াম অরোথিওম্যালেট ইনজেকশনে
- ক্যানসার চিকিৎসা: রেডিওঅ্যাকটিভ স্বর্ণ কণার প্রয়োগ
- চোখ বন্ধ না হওয়ার রোগ (lagophthalmos): চোখের পাতায় স্বর্ণ বসিয়ে স্বাভাবিক বন্ধে সহায়তা
এছাড়া অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, পেসমেকার, ও লাইফ সাপোর্ট যন্ত্রেও স্বর্ণের নির্ভরযোগ্যতা অপরিহার্য।
মহাকাশে স্বর্ণের অবিচল সহযোগিতা
নাসার প্রতিটি মহাকাশযানে স্বর্ণের উপস্থিতি রয়েছে শত শত স্থানে। কারণ-
- বৈদ্যুতিক সংযোগে নির্ভরযোগ্যতা
- যন্ত্রাংশে লুব্রিকেন্ট হিসেবে
- স্বর্ণ-প্রলিপ্ত ফিল্ম ব্যবহার করে সূর্যরশ্মি প্রতিফলন
- স্পেসস্যুটের হেলমেটে স্বর্ণের পাতলা স্তর রশ্মি থেকে রক্ষা করে মহাকাশচারীদের
যেখানে রক্ষণাবেক্ষণের সুযোগ নেই, সেখানে স্বর্ণই ভরসা।
অর্থনীতি ও মুদ্রার পেছনে স্বর্ণ
একসময় পৃথিবীর অনেক দেশের কাগজের টাকার পেছনে স্বর্ণ মজুদ থাকত, যাকে বলে ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’। যদিও আজ আর কোনো দেশ এটি অনুসরণ করে না, তবে স্বর্ণ এখনও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে, গোল্ড বুলিয়ন হিসেবে, স্মারক মুদ্রায় ব্যাপক ব্যবহৃত হয়।
স্বর্ণ সবচেয়ে বেশি পুনর্ব্যবহৃত ধাতু
স্বর্ণের অপ্রতুলতা ও উচ্চমূল্যের কারণে এটি অত্যন্ত বেশি রিসাইকেলযোগ্য। কারখানায় উৎপাদনের সময় পর্যন্ত প্রতিটি ধুলোও সংরক্ষণ করা হয়।
বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য মতে, যে প্রযুক্তির চাহিদা নির্ভুলতা, টেকসইতা ও দীর্ঘস্থায়িত্ব সেখানে স্বর্ণ ছাড়া বিকল্প প্রায় নেই। নতুন আবিষ্কার, স্বাস্থ্য প্রযুক্তি, ন্যানোটেকনোলজি, মহাকাশ অভিযান সবখানেই স্বর্ণের প্রয়োজন ক্রমেই বাড়ছে। তাই এটিকে এখন বলা হচ্ছে ধাতুর ভবিষ্যৎ।
দৈএনকে/ জে. আ
