‘ক্ষুধার চেয়ে মৃত্যু সহজ’ গাজা যেন বেঁচে থাকার চরম শাস্তি


গাজা উপত্যকায় প্রতিটি নতুন দিন এখন শুরু হয় আরও ক্ষুধা, আরও দুর্ভোগ ও মানবিক বিপর্যয়ের ছাপ নিয়ে। টানা তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে দুই মিলিয়নের বেশি মানুষ এক ভয়াবহ সংকটের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। খাদ্য, পানি ও ওষুধের সীমাহীন ঘাটতির পাশাপাশি গাজার মানুষকে সহ্য করতে হচ্ছে লাগাতার সংঘর্ষ ও কঠোর অবরোধ। বাস্তবতাটি যেন একটি দীর্ঘায়িত দুর্ভিক্ষের নির্মম রূপ।
এটি কেবল বঞ্চনার প্রতীক নয়—এটি একটি গভীর মানবিক ট্র্যাজেডি। রাস্তার ধারে অচেতন পড়ে থাকা শিশু, ক্ষুধায় কাতর বৃদ্ধ, এক টুকরো রুটির আশায় অপেক্ষমাণ পরিবার—এই চিত্রগুলো আজ গাজার নিত্যদিনের বাস্তবতা।
দুর্ভিক্ষ এখন শুধু একটি সম্ভাবনা নয়, এটি জীবনের অনিবার্য বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। শিশুদের ক্ষীণ কণ্ঠে খাবারের জন্য আকুতি, মায়েদের সন্তানের মুখে একফোঁটা পানির জন্য সংগ্রাম, আর পুরুষদের নীরব অশ্রু—এসব চিত্র বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেওয়ার কথা, কিন্তু আন্তর্জাতিক মঞ্চে এখনও বিরাজ করছে এক প্রকার অজুহাতপূর্ণ নীরবতা।
মানবাধিকার লঙ্ঘন, যুদ্ধাপরাধ এবং সংকট মোকাবিলায় নিষ্ক্রিয়তা—এই ট্র্যাজেডিকে আরও গভীরতর করে তুলছে। গাজার মানুষের এই অসহনীয় পরিস্থিতি এখন একটি বৈশ্বিক লজ্জা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ- কেউই রেহাই পাচ্ছে না। আমরা নিজের চোখে দেখেছি, ফুটপাতে মৃতদেহ পড়ে আছে। বেকারির ধ্বংসাবশেষের বাইরে বা সাহায্য বিতরণ কেন্দ্রে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, যেখানে আরও কখনও সাহায্য বিতরণ করা হবে না।
এক কেজি আটার দাম ৩০ মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। আর এক কেজি চিনির দাম এখন ১৩০ ডলারেরও বেশি। বেশিরভাগ খাবারই হয় পুরোপুরি পাওয়া যায় না, নয়তো এতটাই দুর্লভ যে কল্পনা করাও যায় না।
ট্র্যাজেডি কেবল দামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অনুপস্থিতিতেও। মানুষ সাধারণত কিনতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে না, কিন্তু কেনার মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই।
তেল নেই, ভাত নেই, রুটি নেই- এমনকি টুনাও নেই। মাঝে মাঝে যা দেখা যায় তা হতে পারে এক মুঠো লাল মরিচ বা ডিশ ডিটারজেন্টের বোতল। এটা অনাহারের মুখে এক ভয়াবহ বিড়ম্বনা।
গাজার দুর্ভিক্ষ কতটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে তা তীব্র ক্লান্তিতে রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষদের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ‘নিরাপদ’ বলে বিবেচিত এলাকাগুলি, যেমন উত্তর রাফা বা কাতানেহ জেলা, মৃত্যু অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। ত্রাণের সন্ধানে এই স্থানগুলিতে যাওয়া ক্ষুধার্ত বেসামরিক নাগরিকদের হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের মতে, মে মাসের শেষের দিক থেকে খাদ্য সহায়তা পাওয়ার চেষ্টা করার সময় ইসরায়েলি বাহিনী হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। প্রতিদিন কয়েক ডজন লোক নিহত হচ্ছে।
জাতিসংঘের প্রাক্তন সাহায্য প্রধান মার্টিন গ্রিফিথস যেমন সতর্ক করেছেন, এই ইচ্ছাকৃত দুর্ভিক্ষ ‘একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে খারাপ অপরাধ।’
সম্ভবত সবচেয়ে হৃদয় বিদারক চিত্র ছিল শিশু ইয়াহিয়া আল-নাজ্জারের। মাত্র কয়েক মাস বয়সী শিশুটি তীব্র অপুষ্টিতে মারা যায়। তার ক্ষুদ্র দেহটি স্বচ্ছ ত্বকে মোড়ানো হাড়ে পরিণত হয়েছিল। এ যেন এক বিধ্বংসী দৃশ্য, যা পুরো বিশ্বের সামনে, ফিলিস্তিনের হৃদয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
