বাংলাদেশের ক্রান্তিলগ্ন: স্থিতিশীলতা ও সংস্কারের সন্ধিক্ষণে


বর্তমান সময় বাংলাদেশের জন্য এক নির্ধারক মুহূর্ত, একটি ক্রান্তিলগ্ন। রাজনৈতিক পালাবদলের ধাক্কা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও সামাজিক অস্থিরতা, সবকিছু মিলে দেশের ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
গত বছরের রাজনৈতিক আন্দোলনের পর দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন সরকারের পতন ঘটে এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। জনআকাঙ্ক্ষা ছিল, এই সরকার নির্বাচনের একটি গ্রহণযোগ্য রোডম্যাপ দেবে, দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ নেবে এবং দেশকে একটি নতুন পথে পরিচালিত করবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনও কোন ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং দ্বিধা, বিভাজন ও পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা সরাসরি দেশের অর্থনীতিতে আঘাত হেনেছে। প্রবৃদ্ধির হার কমে গেছে, মুদ্রাস্ফীতি মানুষকে দিশেহারা করে তুলছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে, ব্যাংকিং খাতে ঋণখেলাপির হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। একদিকে সরকার যেমন অভ্যন্তরীণ চাপে পড়েছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যেমন আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক কাঠামোগত সংস্কারের শর্ত আরোপ করছে, যা স্বল্প-মেয়াদে সাধারণ মানুষের উপরও চাপ সৃষ্টি করছে।
সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, এই সংকটে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণি। বেকারত্ব, চিকিৎসা ব্যয় ও শিক্ষাব্যবস্থার দুরবস্থা মানুষের জীবনযাত্রাকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে। হতাশা, অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা প্রতিটি পরিবারে প্রবেশ করেছে নিঃশব্দে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন দূরদর্শী নেতৃত্ব, রাজনৈতিক ঐক্য ও বাস্তবভিত্তিক অর্থনৈতিক নীতি। কেবলমাত্র ক্ষমতার দখল নয়, প্রয়োজন জনগণের আস্থা অর্জন। একটি নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসতে পারে। আর অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দক্ষতা ফিরিয়ে আনা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের ইতিহাস প্রমাণ করে, সংকটের মধ্যেও এ দেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আজও সেই সুযোগ আছে। কিন্তু সময় দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে। তাই রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, নাগরিক সমাজ এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের একসঙ্গে কাজ করে দেশকে এই ক্রান্তিকাল অতিক্রম করতে হবে। নয়তো, প্রবৃদ্ধির গতি থেমে যাবে, আস্থা হারাবে জনগণ, আর হতাশায় নিমজ্জিত হবে একটি সম্ভাবনাময় জাতি।
