নতুন বাংলাদেশ ও তারেক রহমানের নেতৃত্ব, একটি ঐতিহাসিক প্রয়োজনে উত্থান


২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। দীর্ঘ দমন-পীড়ন, গুম, খুন এবং একদলীয় কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়ে জনতার গণআন্দোলনের বিজয় ছিল কেবল একটি সরকারের পতন নয়’ এটি ছিল এক রাজনৈতিক দিকপরিবর্তনের সূচনা। এই প্রেক্ষাপটে একটি নাম বিশেষভাবে উচ্চারিত হয়েছে, তারেক রহমান। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে নয়, বরং এক নতুন সময়ের নেতৃস্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর উত্থান ঘটেছে একটি ‘ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা’র পরিপ্রেক্ষিতে।
রাজনীতিতে নেতার অবস্থান কেবল সাংগঠনিক নয়, তা আদর্শিকও। ৫ আগস্টের বিজয়ের পর তারেক রহমানের ভাষণ সেই ভাবনাকেই দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে। যেখানে প্রতিশোধের পরিবর্তে উঠে এসেছে সহমর্মিতা, ঐক্য এবং নৈতিক রাষ্ট্রচিন্তার স্পষ্ট প্রতিফলন। এ ভাষণের সংযমিত সুর এবং অন্তর্নিহিত গভীরতা রাজনীতিকে অনতিক্রম্য শত্রুতার মঞ্চ থেকে সরিয়ে একটি মানবিক সংলাপের পথে দাঁড় করিয়েছে। এটি নিছক রাজনৈতিক রণকৌশল নয়, বরং নেলসন ম্যান্ডেলার ‘truth and reconciliation’ ধারণার সাথে তুলনীয় এক নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি।
এই নেতৃত্বের প্রস্তুতি আকস্মিক নয়। ২০২৩ সালেই তারেক রহমান রাষ্ট্র পুনর্গঠনের জন্য একটি সুস্পষ্ট ও সংগঠিত রূপরেখা প্রদান করেন,‘৩১ দফা’ প্রস্তাব। যেখানে দুকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, বিচার ব্যবস্থার সংস্কার, সংবিধানের ৭০ ধারা সংশোধন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং সকল ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর জন্য সমান অধিকারের কথা বলা হয়। এসব প্রস্তাব শুধু রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয়; বরং তা একধরনের institutional imagination, যা নতুন রাষ্ট্রদর্শনের ভিত্তিপ্রস্তর।
তারেক রহমানের নেতৃত্বের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, sacrifice model of leadership,যেখানে নিজের বা দলের স্বার্থ নয়, জাতীয় স্বার্থকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়া হয়েছে। দুইবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না এমন বিধান গ্রহণ, এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও জাতীয় ঐক্যমতের সরকার গঠনের ঘোষণা এ কথা স্পষ্ট করে যে, এ নেতৃত্ব ক্ষমতা নয়, দায়িত্বের প্রতিচ্ছবি।
দলীয় কাঠামোয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতৃত্ব নির্বাচন এবং তৃণমূল নেতাদের মূল্যায়ন, বিএনপিকে সংগঠনের দিক থেকে নতুন প্রাণ দিয়েছে। অন্যদিকে, তারেক রহমানের গণমাধ্যম বিষয়ক অবস্থান, যেখানে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপকেও গণতান্ত্রিক চর্চা হিসেবে দেখা হয়,তা বর্তমান সময়ের নেতৃত্বের বিরল উদাহরণ। এককেন্দ্রিক দমনমূলক শাসনের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের উদারতা শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি সংস্কৃতিরও পরিবর্তন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সংকটের মুহূর্তে নতুন নেতৃত্বের উত্থান নতুন কিছু নয়। যেমন ১৯৭৫-এ জিয়াউর রহমান সামরিক ও রাজনৈতিক শূন্যতার প্রেক্ষাপটে নেতৃত্বে আসেন এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের সূত্রপাত করেন। ঠিক তেমনই, আজকের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকটে তারেক রহমান ইতিহাসের স্বাভাবিক ধারাবাহিকতায় এক ‘ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা’র প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
পলিটিক্যাল থিওরিতে বলা হয়, “When institutions fail, leadership must evolve from legitimacy, not convenience.” সেই বিবেচনায়, তারেক রহমান কেবল একজন দলীয় নেতা নন, বরং পরিবর্তনের জন-আকাঙ্ক্ষার মুখপাত্র।
বাংলাদেশ বর্তমানে একটি ভূরাজনৈতিক মেরুকরণের মুখোমুখি—ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। এমন প্রেক্ষাপটে নেতৃত্ব তখনই গ্রহণযোগ্য হয়, যখন তা অভ্যন্তরীণ গণআকাঙ্ক্ষা ও আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম হয়। তারেক রহমানের “সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়” নীতিনির্ধারণ সেই ভারসাম্য প্রতিষ্ঠারই ঘোষণা।
যদিও তারেক রহমানের নেতৃত্বে আশা ও সম্ভাবনার এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছে, তবু সামনে রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ। সাংবিধানিক সংস্কার বাস্তবায়ন, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গঠন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা এবং সামাজিক সম্প্রীতি নিশ্চিতকরণ, সবকিছুই একটি দীর্ঘ, জটিল প্রক্রিয়া। নেতৃত্বের সফলতা নির্ভর করবে এই প্রতিশ্রুতিগুলোর বাস্তবায়নের ওপর।
আজকের তারেক রহমান শুধু বিএনপির ভবিষ্যৎ নন, বরং দেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের পরীক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তিনি নেতৃত্বের নৈতিকতা, রাষ্ট্রীয় চিন্তার নবায়ন এবং জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবির সংমিশ্রণে এক নতুন রাজনৈতিক বয়ান নির্মাণ করছেন। এটি কেবল ব্যক্তিকেন্দ্রিক আবেগ নয়, বরং ইতিহাস, কৌশল এবং নেতৃত্বতত্ত্বের এক সংহত প্রয়াস।
নতুন বাংলাদেশের যাত্রা যদি স্থায়ী ও ন্যায্য হয়, তবে সেই অভিযাত্রায় তারেক রহমানের নেতৃত্বকে ‘ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা’ হিসেবে দেখা সময়োপযোগী এবং যুক্তিসঙ্গত। তবে এই নেতৃত্বকে স্থায়িত্ব দিতে হলে প্রয়োজন হবে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং প্রতিশ্রুতিগুলোর বাস্তব প্রতিফলন। ইতিহাস সুযোগ দেয়, কিন্তু দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হয়। এখন সময়, সেই দায়িত্ব পালনের।
