আইএমইডির দুর্নীতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ


জনগণের ট্যাক্সের অর্থে পরিচালিত দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর তদারকি, পরিবীক্ষণ ও প্রভাব মূল্যায়নের দায়িত্ব যার ওপর— সেই বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) নিজেই আজ দুর্নীতি, অপচয় ও স্বেচ্ছাচারের ভয়াবহ চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি ৪ কোটি টাকার কাজ ২৬ কোটিতে বাস্তবায়নের অভিযোগসহ ব্যাগ-ফোল্ডার, আপ্যায়ন, সহায়ক জনবল এমনকি অতিথি সম্মানীসহ বিভিন্ন খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের ভয়াবহ অপব্যবহারের তথ্য আমাদের সামনে স্পষ্ট করেছে যে, সুশাসন ও জবাবদিহিতার অভাবে কীভাবে একটি সরকারি বিভাগে লুটপাটের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।
এই অবস্থা গভীরভাবে উদ্বেগজনক এবং জাতীয় অর্থনীতির ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম। কারণ আইএমইডি একটি নিরীক্ষক সংস্থা, যার মূল কাজ অন্য সংস্থাগুলোর কাজ পর্যবেক্ষণ করে উন্নয়ন প্রকল্পের কার্যকারিতা যাচাই ও করদাতাদের অর্থের যথাযথ ব্যবহারের নিশ্চয়তা দেওয়া। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই প্রতিষ্ঠান নিজেই আজ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার চরম ঘাটতির নমুনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিবেদনে প্রকাশিত খাতভিত্তিক বিশ্লেষণ এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। ৭৬টি প্রকল্পের জন্য ২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা নিজস্ব জনবল দিয়েই সর্বোচ্চ চার কোটি টাকায় করা যেত। অর্থাৎ মাত্র এই একটি উদ্যোগেই প্রায় ২২ কোটি টাকার অপচয় হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সম্মানী, আপ্যায়ন, ব্যাগ-ফোল্ডার, সহায়ক জনবল ইত্যাদি খাতেও অযৌক্তিক ব্যয় ও নগদ অর্থ ভাগাভাগির অভিযোগ প্রমাণ করে, এটি পরিকল্পিত দুর্নীতির চিত্র।
ব্যয় বিভাজনে দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র ‘ব্যাগ-ফোল্ডার’ বাবদ বরাদ্দ ছিল প্রায় দুই কোটি ১৯ লাখ টাকা, অথচ বাস্তবে কোনো ব্যাগ দেওয়া হয়নি; বরং নগদ অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে। এমনকি স্টেশনারি খাতে বরাদ্দ দেওয়া ৩৮ লাখ টাকার কোনো খরচ হয়নি, অথচ টাকার শতকরা ৭০ ভাগ প্রশাসনিক শাখায় জমা ও ৩০ ভাগ কর্মকর্তাদের মধ্যে ভাগ করা হয়েছে— যা সরাসরি দুর্নীতির শামিল।
আইএমইডি নিজস্ব জনবল দিয়ে মূল্যায়ন কার্যক্রম চালাতে সক্ষম হলেও প্রশ্নবিদ্ধভাবে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কিছু প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, যাদের যোগ্যতা বা নিরপেক্ষতা নিশ্চিত নয়। অথচ দেশের সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস বা অন্যান্য স্বীকৃত গবেষণা সংস্থা দিয়ে এই কাজগুলো করানো গেলে দক্ষতা, স্বচ্ছতা এবং গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব হতো।
আইএমইডির মূল্যায়ন প্রতিবেদনগুলো যে কার্যত অর্থহীন হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা নিজেই স্বীকার করেছেন বিআইডিএস’র মহাপরিচালক। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, "আইএমইডি রিপোর্টে আসলে কিছুই পাওয়া যায় না।" এত বড় এক পর্যালোচনামূলক সংস্থার মুখে এমন কথা শোনার পরও যদি শুদ্ধি অভিযান না শুরু হয়, তবে প্রশ্ন ওঠে— কে শাসন করবে শাসকদের?
এই দুর্নীতির দায় শুধু কয়েকজন কর্মকর্তার নয়; এটি পুরো প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর ব্যর্থতার প্রতিফলন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার যখন ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা বলে, তখন সরকারি সংস্থা আইএমইডিতে প্রকাশ্য দুর্নীতি এই অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
একটি তদারকি সংস্থা যদি নিজেই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত থাকে, তবে অন্য সংস্থার জবাবদিহিতা কে নিশ্চিত করবে? এমন অনিয়মের বিরুদ্ধে দ্রুত, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত অত্যাবশ্যক। জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া হলে, এই ধরনের লুটপাটের সংস্কৃতি আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে।
প্রত্যেকটি প্রকল্পের প্রতিটি টাকাই জনগণের ঘামঝরা আয় থেকে আসে, হয় সরাসরি করের মাধ্যমে, নয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর ঋণের বোঝা চাপিয়ে। এই অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা কেবল সরকারের দায়িত্ব নয়, এটি একটি নৈতিক কর্তব্য।
আজ যে অর্থ লুটপাট হচ্ছে, তা দিয়েই হয়তো আরও একটি স্কুল হতো, আরও একটি সেতু নির্মিত হতো, একটি ইউনিয়নে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানো যেতো। দুর্নীতির এই চক্র মূলত আমাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকেই বাধাগ্রস্ত করছে।
আইএমইডির এই দুর্নীতি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কাঠামোতে একটি সতর্ক সংকেত। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুধু বক্তব্য নয়, চাই কার্যকর পদক্ষেপ। জনগণের অর্থে পরিচালিত প্রতিটি প্রকল্পে স্বচ্ছতা, কার্যকারিতা এবং কঠোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতেই হবে। নয়তো ‘উন্নয়ন’ কেবল পরিসংখ্যানেই থাকবে, বাস্তবে তার সুফল জনগণের হাতে পৌঁছাবে না।
