জুলাই: স্মৃতির প্রদীপে আগামী সম্ভাবনার রেখাচিত্র


বাংলাদেশের ইতিহাসে জুলাই একটি মাস নয়, একটি চেতনার নাম। এটি কেবল বর্ষপঞ্জির একটি পর্ব নয়, বরং একটি রক্তক্ষরণ, প্রতিরোধ ও প্রত্যয়ের নিঃশব্দ উচ্চারণ। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে যা ঘটেছিল—তা রাজনীতির বইয়ে লেখা থাকে না কেবল, থাকে মানুষের মনস্তত্ত্বে, হূদয়বৃত্তে। সেই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে আমরা আজ যে ৩৬ দিনের কর্মসূচির সাক্ষী, তা অতীতকে স্মরণ করার এক প্রথামাফিক আয়োজন নয়—বরং বর্তমানকে প্রশ্ন করার এক দুর্লভ সুযোগ।
শহীদদের রক্ত, আহতদের আর্তনাদ আর প্রত্যয়ী জনতার অগ্নিঝরা স্বপ্ন আজ ইতিহাসের পাতায় অমলিন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, সেই স্মৃতি কাকে দায়ী করে? রাষ্ট্র কি সেই ত্যাগের ঋণ শোধ করেছে? রাজনৈতিক দলগুলো কি সেই আত্মত্যাগকে মর্যাদা দিতে পেরেছে, নাকি এটিকেও পরিণত করেছে ইভেন্ট-ভিত্তিক এক ‘স্মৃতি-শো’-তে?
স্মরণ, শোক, আলোচনা, কবর জিয়ারত, প্রদর্শনী, পদযাত্রা, রক্তদান, সবই হচ্ছে, হচ্ছে নানা আয়োজন। কিন্তু তা যদি বাস্তবায়িত ন্যায়ের ধারায় বাঁক না নেয়, তবে এই আয়োজন হবে আত্মার বদলে আনুষ্ঠানিকতার অভিনয়।
এই কর্মসূচিগুলোতে একটি আশার ইঙ্গিত আছে, রাজনীতি যেন আবার মাঠে, মানুষের মাঝে ফিরে যেতে চাইছে। ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’, ‘গণঅভ্যুত্থান ২০২৪: জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’, ‘মার্চ ফর জুলাই রিভাইভস’ কিংবা ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন’ এগুলো কেবল নাম নয়, এগুলো রাজনীতির পুনর্জাগরণের ভাষ্য। যদি দলগুলো এসব কর্মসূচিকে আন্তরিকতার সঙ্গে জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তবে তা গণতন্ত্রের পুনর্গঠনে সহায়ক হবে।
একটি বিষয় স্পষ্ট, জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক শক্তি, মতাদর্শ নির্বিশেষে, নিজ নিজ ভাষায় স্মরণ করছে শহীদদের। কেউ দোয়া করছে, কেউ কনফারেন্স করছে, কেউ আবার কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে। এই বহুমাত্রিকতা গণতন্ত্রের প্রাণ। শর্ত একটাই, এ যেন কেবল কৌশলগত অবস্থান না হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে নীতিগত সংহতির ভিত্তি।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ যেমন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবৃত্তি, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দোয়া, এসব প্রশংসনীয়। তবে শুধু প্রতীকী কর্মকাণ্ড নয়, প্রয়োজন শহীদ পরিবারদের যথাযথ সম্মান, আহতদের পুনর্বাসন, এবং সেই সময়ের সহিংসতার দায় নিরূপণ ও বিচার নিশ্চিত করা। ইতিহাস তখনই মূল্য পায়, যখন রাষ্ট্র তার দায় স্বীকার করে, এবং দায়িত্বশীলভাবে সে দায় পালন করে।
২০২৪ সালের জুলাইয়ের ঘটনাগুলো তরুণ প্রজন্মের অনেকের কাছেই হয়তো শুধু সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা, কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার হ্যাশট্যাগ। কিন্তু ইতিহাস শুধু জানার নয়’ বোঝার, ধারণ করার এবং নিজের ভেতর ধারণ করে পথচলার। কর্মসূচিগুলোর মধ্যে তরুণদের অংশগ্রহণ, তাদের ভাবনা, তাদের নেতৃত্ব এই বর্ষপূর্তিকে শুধু স্মরণ নয়, ভবিষ্যতের একটি প্রস্তুতি করে তুলতে পারে।
জুলাই আমাদের মনে করিয়ে দেয়, নিষ্পেষণের মুখেও প্রতিবাদ থেমে থাকে না, যন্ত্রণা ছাপিয়েও গণজাগরণ জন্ম নেয়, এবং অনিশ্চিত পথের যাত্রী হলেও মানুষ হার মানে না। এই ৩৬ দিনের কর্মসূচি যদি কেবল একবছর আগের এক ঘটনার পুণ্যস্মরণ হয়, তবে তা পাণ্ডিত্যপূর্ণ নস্টালজিয়া ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু যদি তা হয়ে ওঠে গণতন্ত্রের পুনর্জন্মের আহ্বান, তবে জুলাই শুধু অতীত নয়, একটি জীবন্ত ভবিষ্যৎ।
