জলবায়ু পরিবর্তন: কীভাবে এবং কেন ঘটছে?


পৃথিবী যেন ক্রমেই বদলে যাচ্ছে অথচ বদলটা আমরা হয়তো চোখে দেখছি না, কিন্তু ত্বকে টের পাচ্ছি। আগের মতো আর নির্ভরযোগ্য ঋতু নেই, বৃষ্টি আসে হঠাৎ করে, আবার খরা দীর্ঘস্থায়ী হয়। সমুদ্র যেন ধীরে ধীরে ভেতরে টেনে নিচ্ছে আমাদের উপকূল, আর গ্রীষ্ম যেন বারবার অতর্কিতে দগ্ধ করে তোলে জনজীবন।
এই যে প্রকৃতির আচরণে এমন পরিবর্তন এটাই জলবায়ু পরিবর্তন। কিন্তু এই পরিবর্তন কি হঠাৎ? এর কারণ কি শুধুই প্রকৃতি? নাকি মানুষই নিজের ভবিষ্যৎকে অজান্তে বিপন্ন করে তুলছে?
জলবায়ু পরিবর্তন আসলে কী?
জলবায়ু মানে হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের দীর্ঘমেয়াদি তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহসহ আবহাওয়ার স্বাভাবিক গড় চিত্র। কিন্তু যখন এই চিত্রে দীর্ঘস্থায়ী, অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটে তখনই তাকে আমরা বলি জলবায়ু পরিবর্তন। এই পরিবর্তন হয় ধীরে ধীরে। কিন্তু এর প্রভাব হতে পারে হঠাৎ, তীব্র এবং ধ্বংসাত্মক।
কেন ঘটছে এই পরিবর্তন?
১. গ্রীনহাউস গ্যাসের বেড়ে যাওয়া
আমরা প্রতিদিন যে জ্বালানি ব্যবহার করছি—যেমন কয়লা, গ্যাস, পেট্রোল তা পোড়ালে বাতাসে জমা হয় প্রচুর কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO₂)।
এছাড়া কৃষিকাজ ও গবাদিপশুর কারণে বেড়ে যাচ্ছে মিথেন (CH₄) ও নাইট্রাস অক্সাইড (N₂O)।
এই গ্যাসগুলো সূর্যের তাপকে আটকে রাখে পৃথিবীর চারপাশে, ফলে বাড়ে গড় তাপমাত্রা। এটাকেই বলে গ্রীনহাউস এফেক্ট, যা জলবায়ু পরিবর্তনের মূল চালক।
২. বনভূমি ধ্বংস
বৃক্ষেরা প্রাকৃতিকভাবে বাতাস থেকে CO₂ শোষণ করে। কিন্তু বন উজাড়ের ফলে এই প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, বাড়ছে তাপমাত্রা।
৩. শিল্পায়ন ও নগরায়ন
নগর ও কলকারখানার দ্রুত সম্প্রসারণে মানুষ পৃথিবীর শ্বাস-প্রশ্বাসের পথ আটকে দিচ্ছে। নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে, এবং পানি ও বায়ু দূষণ বেড়েই চলেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কী ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে?
সমুদ্র গিলে খাচ্ছে উপকূল
বরফ গলছে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে, বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। বাংলাদেশের মতো নিচু দেশের জন্য এটি এক মহাসঙ্কেত। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী কয়েক দশকে দেশের উপকূলীয় বহু অঞ্চল স্থায়ীভাবে পানির নিচে চলে যেতে পারে।
অস্বাভাবিক আবহাওয়া
একদিকে খরার কারণে ফসল শুকিয়ে যায়, অন্যদিকে হঠাৎ ঘূর্ণিঝড় বা অতিবৃষ্টিতে বন্যা, এই দুই বিপরীত চাপে পড়ে কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি ধ্বংসের পথে।
মানবস্বাস্থ্য হুমকির মুখে
তাপদাহ, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও পানিবাহিত রোগ এখন ঘনঘন ও ভয়াবহ আকারে ফিরে আসছে। শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য এসব রোগ হয়ে উঠেছে জীবনহানির কারণ।
প্রকৃতি হারাচ্ছে প্রাণ
প্রাণীকূল ও উদ্ভিদের হাজার হাজার প্রজাতি জলবায়ুর ধাক্কায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে।
বাংলাদেশ কেন সবচেয়ে ঝুঁকিতে?
বাংলাদেশ একদিকে নদীমাতৃক, অন্যদিকে ঘনবসতিপূর্ণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। এই ভূপ্রকৃতিগত অবস্থান একে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার করে তুলেছে।
একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়তে পারে শুধু জলবায়ুর কারণে।
সমাধানের পথ কোথায়?
* পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার করা, যেমন সোলার বা বায়ুশক্তি
* বনায়ন ও বন সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া
* পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়া
* টেকসই নগর উন্নয়ন, যেখানে প্রকৃতি ও নগর থাকে সহাবস্থানে
* পরিবেশ শিক্ষা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি
* আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও বৈশ্বিক কার্বন নীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখা
জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর শুধু বিজ্ঞানীর ভাষণ নয়, এটি প্রতিদিনের বাস্তবতা। এটি কেবল ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য বিপদ নয়’ এটি এখনকার শিশুর, কৃষকের, জেলেপাড়ার, শহরের, এমনকি আমাদের সবার জন্যই এক অনিবার্য সংকট।
পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে আগে আমাদের মনোভাব বদলাতে হবে। প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয় না, প্রতিফলন ঘটায়, যা আমরা করছি, তাই সে ফিরিয়ে দিচ্ছে। সুতরাং প্রশ্ন নয়, এখন সময় করার।
