শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫
Natun Kagoj

দাবির নামে স্থবিরতা: অর্থনীতি কি জিম্মি?

দাবির নামে স্থবিরতা: অর্থনীতি কি জিম্মি?
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চলমান শাটডাউন কর্মসূচি দেশের অর্থনীতির উপর এক গভীর ও তাৎক্ষণিক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এই অচলাবস্থা শুধু আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যেই বিঘ্ন ঘটাচ্ছে না, বরং এর মাধ্যমে গোটা উৎপাদনমুখী খাত ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রক্রিয়া চরম সংকটের দিকে ঠেলে যাচ্ছে। এমন একটি সময়ে, যখন বৈশ্বিক মন্দা ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশ অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার চেষ্টায় নিয়োজিত, তখন রাজস্ব ব্যবস্থার এমন অচলাবস্থা জাতির জন্য অশনিসংকেত।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, এনবিআরের অধীন দপ্তরগুলোর সীমিত সময়ের কার্যক্রমের ফলে কাঁচামাল খালাস, রপ্তানি পণ্য ছাড়করণসহ জরুরি শুল্কসেবা কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়েছে। এতে করে তৈরি পোশাক, চামড়া, সিরামিক, ওষুধ, কৃষিপণ্যসহ বিভিন্ন রপ্তানিমুখী খাতে উৎপাদন ও সময়ানুযায়ী সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে। যে রপ্তানি আদেশগুলি নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে পূরণ না হলে তা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর হাতে চলে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে, সেগুলোর বিলম্ব মানেই শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়, বরং বৈদেশিক বাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ক্ষতিও অনিবার্য।

উল্লেখ্য, এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি ও অসন্তোষ নিশ্চয়ই কোনো শূন্য থেকে আসেনি। তবে এসব সমস্যা সমাধানের পথ কখনোই রাষ্ট্রীয় পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে না। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান যদি স্বয়ং অচল হয়ে পড়ে, তবে তার অভিঘাত পুরো অর্থনীতি ও জনগণের ওপর গিয়ে পড়ে। তাই বিষয়টি যত দ্রুত সম্ভব সমাধানে পৌঁছানো এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

সরকার ও আন্দোলনরত পক্ষ উভয়ের প্রতি আমাদের আহ্বান—এই সংকট যেন কোনো পক্ষের ‘ইগোর’ বলি না হয়। প্রয়োজন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য আলোচনার টেবিলে বসে সমাধানে পৌঁছানো। বিশেষত যখন দেশের ব্যবসায়িক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো আগেই নানা সংকটে জর্জরিত, তখন এই ধরনের দ্বন্দ্ব আরও বেশি অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাঠামোগত সংস্কার বা আধুনিকায়নের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই, তবে তার প্রক্রিয়া যেন কোনোভাবেই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শ্রমবাজার ও বিনিয়োগ পরিবেশকে বিপন্ন না করে।

বিশেষ করে জুন-জুলাই মাস ব্যবসায়ীদের জন্য সবচেয়ে চাপের সময়। ব্যাংক ঋণের সুদ পরিশোধ, অর্ডার ডেলিভারি, উৎস কর ও রপ্তানি আয় নিশ্চিত করার এই সময়ে কোনো ধরনের দাপ্তরিক অচলাবস্থা অর্থনৈতিক কাঠামোকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে যে অনাস্থার সঞ্চার হয় এমন পরিস্থিতিতে, তা ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দিতে পারে।

আমরা আশা করি, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল থেকে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া হবে এবং অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি কার্যকর আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হবে। একই সঙ্গে আমরা এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে আহ্বান জানাই—আপনারা দেশের স্বার্থে, অর্থনীতির স্বার্থে, সাধারণ ব্যবসায়ী ও জনগণের স্বার্থে কলম বিরতি ও শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে দ্রুত স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরে যান। দাবি থাকবে, যুক্তিসংগত সংস্কার ও প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হোক।

শেষ কথা হলো, দেশের অর্থনীতিকে চলমান বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জের মধ্যে টিকিয়ে রাখতে হলে রাজস্ব ব্যবস্থার স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও সেবামূলক মানোন্নয়নের বিকল্প নেই। তবে তার পথ হতে হবে আলোচনাভিত্তিক, সবার অংশগ্রহণে গঠিত, গঠনমূলক এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনীতিকে অক্ষুণ্ন রাখার চিন্তায় পরিচালিত। দেশ আজ সংকটে, কিন্তু আলোচনার মাধ্যমে সেই সংকট উত্তরণের পথও এখনো উন্মুক্ত। আমরা আশাবাদী, সেই পথে সবাই এগিয়ে আসবেন।


গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন