ইসলামিক ফাউন্ডেশনে প্রশাসনিক অনিয়মের ঘটনা প্রকাশ


* ৫ জন সহকারী পরিচালক কে সিলেকশন কমিটির সুপারিশ ছাড়াই উপ-পরিচালক পদে পদোন্নতি
* উচ্চ আদালতের স্তগতিতাদেশ থাকা সত্ত্বেও উপরিচালক পদে পদোন্নতির উদ্যোগ গ্রহণ
* নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ উন্নয়নে মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম (৮ম পর্যায়ে) শীর্ষক প্রকল্পে সিলেকশন কমিটির যাচাই-বাছাই ছাড়াই ৭৮৭ জন জনবল পুনর্বহাল ও ৬ মাসের বেতন ভাতা প্রদান
* ছাত্র জনতার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আখ্যায়িত করে মানববন্ধনকারী ২১৫০ জন মডেল ও সাধারণ কেয়ারটেকারদের যাচাই-বাছাই ছাড়াই চাকরিতে পুনর্বহাল
ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম মন্ত্রণালয় কর্তৃক যথাযথ মনিটরিং ও তত্ত্বাবধায়ন না করার কারণে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে অনিয়মই যেন নিয়মে পরিণত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর মহাপরিচালক জনাব আব্দুস সালাম খান জুডিশিয়াল ক্যাডারের লোক হওয়ায় তার বাংলাদেশ সার্ভিস রুলস, ফিনান্সিয়াল ডেলিগেশন রুলস ও পিপিআর সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই। এই সুযোগে কিছু অসাধু কর্মকর্তারা তাদের অবৈধ সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছে। গত ১৩ আগস্ট ২০২৫ তারিখে ৫ জন সহকারী পরিচালককে অবৈধভাবে উপ পরিচালক পদে পদোন্নতি প্রদান করা হয়।
সরকারি বিধি অনুযায়ী ৬ষ্ঠ গ্রেড ও তদূর্ধ্ব পদে পদোন্নতি প্রদানের জন্য প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের সচিব কে সভাপতি করে একটি সিলেকশন কমিটি রয়েছে। উক্ত কমিটি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ দপ্তর ও সংস্থার কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সুপারিশ করবেন। কিন্তু এ পদোন্নতির ক্ষেত্রে বর্ণিত কমিটির কোন সুপারিশ গ্রহণ করা হয়নি । সিলেকশন কমিটির সুপারিশ ছাড়াই বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে মহাপরিচালকের স্বাক্ষরে পদোন্নতির পত্র ইস্যু করা হয়। শুধু পদোন্নতি নয় তাদেরকে গত ২৫/৭/২০১০ তারিখ থেকে ভূতাপেক্ষভাবে জ্যেষ্ঠতা ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়েছে।
পদোন্নতি প্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে জনাব এ কে এম মুজাহিদুল ইসলাম এর বিরুদ্ধে২০১০ সনে বিভাগীয় মামলা ও শাস্তি ছিল, জনাব মোঃ মহসিন খান এর বিরুদ্ধেও বিভাগীয় মামলা ছিল। কোন নিয়ম নীতি অনুসরণ না করেই তাদের বিভাগীয় মামলা ও শাস্তি প্রত্যাহার করা হয়। জনাব মোঃ মাহবুবুল আলম ও জনাব মোঃ ইমামুল ইসলাম দুজনের চাকরি রেকর্ড সন্তোষজনক ছিল না। জনাব মঞ্জুরুল আলম মজুমদার গত বছর ডিসেম্বর মাসে এলপিআরে গমন করেন তাকেও এ পদোন্নতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। উল্লেখ্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সহকারী পরিচালক পদ থেকে উপপরিচালক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের স্থগতিতাদেশ রয়েছে। মহাপরিচালক উচ্চ আদালতের আদেশ আমলে না এনে সরকার কর্তৃক গঠিত সিলেকশন কমিটিকে পাশ কাটিয়ে পদোন্নতিপত্র ইস্যু করে দেন। এতে ফাউন্ডেশনে পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমানে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রধান কার্যালয়ে দুইজন মহিলা পরিচালক ছাড়া আর সব পরিচালককে ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়েছে। যে দুইজনকে ঢাকায় রাখা হয়েছে তাদের দুইজন রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত। তাদের একজন সরাসরি ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তার স্বামী যুবলীগ নেতা বর্তমানে পলাতক রয়েছেন।
অপর দিকে, বিগত সরকারের আমলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে সংঘটিত সকল অনিয়ম ও দুর্নীতি উদঘাটনের জন্য সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর এর নেতৃত্বে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু তদন্ত কমিটিকে তার কার্যক্রম পরিচালনায় বাধা দিচ্ছে ফ্যাসিবাদের দোসররা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে এমনকি খোদ প্রশাসন বিভাগেও সাবেক মহাপরিচালক শামীম আফজালের নিয়োগকৃত ফ্যাসিবাদী লোক থাকার কারণে কমিটিকে কোন প্রকার সঠিক তথ্য ও উপাত্ত সরবরাহ না করে তদন্ত কাজে অসহযোগিতা করা হচ্ছে।
সাবেক মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল ২০০৯ সালের শুরুতে নিয়োগ পেয়ে ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠানটির রাজস্ব খাতভুক্ত প্রথম শ্রেণির ১২টি পদে ৪৭ জনকে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি করে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই নিয়োগে কোনো বিধি-বিধান মানা হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১২ সালের ওই নিয়োগের সুপারিশপত্রে সই করেননি কমিটির সদস্যসচিব, জনপ্রশাসন, অর্থ ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রতিনিধি। লিখিত পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্তদের মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করানো এবং সর্বনিম্ন নম্বরপ্রাপ্তদের সর্বোচ্চ নম্বর দেওয়া হয়েছে। নিয়োগের যোগ্যতা ছিল ছাত্রলীগের পরিচয়। ইতোমধ্যে তাদের নিয়োগ কেন অবৈধ হবে না মর্মে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করা হয়েছে এবং আদালত থেকে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে ।কিন্তু বর্তমান প্রশাসন আদালতের নির্দেশনা অবজ্ঞা করে অবৈধভাবে নিয়োগকৃত এ সকল কর্মকর্তাদেরকে উপ পরিচালক পদে পদোন্নতি প্রদানের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ উন্নয়নে মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম (৮ম পর্যায়ে) শীর্ষক প্রকল্পটি ২০২৪ জানুয়ারি থেকে ২০৩০ জুন মেয়াদে গত ২৪ মে ২০২৫ তারিখে একনেক সভায় অনুমদিত হয়। প্রকল্প দলিলে ৭৩৭৬৮ টি শিক্ষা কেন্দ্রের মাধ্যমে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও কোরআন শিক্ষা প্রদান করা হবে । প্রত্যেকটি শিক্ষাকেন্দ্রে একজন করে শিক্ষক দায়িত্ব পালন করবেন ।
তাদের প্রত্যেককে মাসিক ৬০০০ টাকা করে সম্মানি প্রদান করা হবে। শিক্ষা কেন্দ্র সমূহ পরিদর্শন ও শিক্ষা কার্যক্রম মনিটরিং করার জন্য ২১৫০ জন মডেল ও সাধারণ কেয়ারটেকার নিয়োজিত থাকবে । প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন পদে সাকুল্যে ও আউটসোর্সিং বেতনে ৭৮৭ জন কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োজিত থাকবে। প্রকল্পের জনবল নিয়োগ বা বহাল করার জন্য প্রকল্প দলিলে ২টি নিয়োগ কমিটি রয়েছে ।
ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয় নিয়োগ কমিটি-১ এবং প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ কমিটির-২ এর সভাপতি দায়িত্ব পালন করবেন । প্রকল্প দলিলে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে ৭ম পর্যায় প্রকল্পের জনবল যাচাই-বাছাই করে ৮ম পর্যায়ে নিয়োগ বা বহাল করা হবে। কিন্তু প্রকল্পের নির্দেশনা অনুসরণ না করে ৭ম পর্যায়ের সমাপ্ত প্রকল্পের জনবল গঠিত সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে যাচাই-বাছাই ব্যতিরিকে ৮ম পর্যায় বহাল করা হয়েছে এবং গত জানুয়ারি ২০২৫ থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত ৫ মাসের বেতন ভাতা পরিশোধ করা হয়েছে। যা সম্পূর্ণরূপে প্রকল্প দলিলের বেত্যয়। প্রকল্পের ৭ম পর্যায়ে নিয়োগকৃত অধিকাংশ জনবল ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগের আমলে বিভিন্ন তদবিরের মাধ্যমে নিয়োগ করা হয়েছে। এ সকল জনবল দেশের প্রত্যেকটি জেলা উপজেলায় গত ফ্যাসিস্ট সরকারের সভা সমাবেশে লাঠিয়াল বাহিনী ও জনবল যোগানদাতার দায়িত্ব পালন করত ।
২০২৪ এর ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের পূর্ব দিনে ৪ আগস্ট বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের সামনে ছাত্র জনতার আন্দোলনকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আখ্যায়িত করে আন্দোলনকারীদের শাস্তি দাবি করে মানববন্ধন পালন করেন। তৎকালীন প্রকল্পে কর্মরত প্রকল্প পরিচালক সহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ মানববন্ধনের নেতৃত্ব দেন । আওয়ামী ফ্যাসিস্ট আমলে প্রকল্পের ৭ম পর্যায়ে নিয়োগকৃত এ সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে প্রকল্প দলিলের নির্দেশনা তোয়াক্কা না করে কোন প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়াই ৮ম পর্যায়ে প্রকল্পে নিয়মিতকরণ না করে ৫ মাসের বেতন ভাতা প্রদান করা হয়।
