ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ, সাবেক মন্ত্রী জাবেদসহ আসামি ২৪ জন


সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন আরামিট গ্রুপের চিফ অপারেটিং অফিসার ও কোম্পানি সেক্রেটারি সৈয়দ কামরুজ্জামান। তিনি নিজের ফুফাতো ভাই সৈয়দ নুরুল ইসলামকে ‘ক্রিসেন্ট ট্রেডার্স’ নামক প্রতিষ্ঠানের মালিক সাজান। এরপর প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে (ইউসিবি) একটি হিসাব খোলা হয়। সেখানে ২৫ কোটি টাকার ঋণের জন্য আবেদন করা হয় এবং ব্যাংকের জুবলী রোড শাখার কর্মকর্তাদের সুপারিশে সেই ঋণও মঞ্জুর হয়। অথচ 'ক্রিসেন্ট ট্রেডার্স' নামের প্রতিষ্ঠানটি ছিল ভুয়া! মূলত টাকা আত্মসাৎ করতেই এই কৌশল নেওয়া হয়েছিল, যা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) সকালে ঋণ নিয়ে টাকা আত্মসাতের এই ঘটনায় দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১-এ একটি মামলা দায়ের করেন দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ শোয়াইব ইবনে আলম। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১-এর উপপরিচালক সুবেল আহমেদ। তিনি জানান, তদন্তকালে অন্য কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মামলায় আসামি করা হয়েছে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, তার স্ত্রী ও ইউসিবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান রুকমীলা জামানসহ মোট ২৪ জনকে।
বাকি আসামিরা হলেন, ইউসিবি ব্যাংকের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান বজল আহমেদ বাবুল, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল এহতেশাম আবদুল মোহাইমিন, সাবেক পরিচালক ইউনুছ আহমদ, এম. এ. সবুর, আসিফুজ্জামান চৌধুরী, হাজী আবু কালাম, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, রোকসানা জামান চৌধুরী, বশির আহমেদ, সৈয়দ কামরুজ্জামান, মো. শাহ আলম, শরীফ জহির এবং ড. সেলিম মাহমুদ।
অন্য আসামিরা হলেন, ব্যাংকটির সাবেক সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার শ্রাবন্তী মজুমদার, সাবেক এক্সিকিউটিভ অফিসার মুঝায়োনা সিদ্দিকা, সাবেক এভিপি ও ক্রেডিট অফিসার মোহাম্মদ গোলাম রাকিব, সাবেক এফএভিপি ও ম্যানেজার অপারেশন মোসাদ্দেক মো. ইউসুফ, সাবেক এফভিপি ও কারওয়ান বাজার শাখার প্রধান আলমগীর কবির।
নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের তথাকথিত মালিকদের মধ্যে রয়েছেন, প্রগ্রেসিভ ট্রেডিংয়ের মালিক ও আরামিট সিমেন্ট লিমিটেডের সহকারী ব্যবস্থাপক (হিসাব) মোহাম্মদ হোছাইন চৌধুরী, ইম্পেরিয়াল ট্রেডিংয়ের মালিক ও আরামিটের এজিএম মো. আব্দুল আজিজ এবং আরামিট সিমেন্টের পিয়ন মো. ইয়াছিনুর রহমান।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ‘ক্রিসেন্ট ট্রেডার্স’ নামীয় কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের চট্টগ্রামের জুবলী রোড শাখায় যাচাই-বাছাই ছাড়া একটি হিসাব খোলা হয়। এরপর গ্রাহক সৈয়দ নুরুল ইসলামের ঋণ আবেদনের ভিত্তিতে শাখার কর্মকর্তারা মিথ্যা তথ্যসহ একটি পরিদর্শন প্রতিবেদন তৈরি করেন এবং শাখার ক্রেডিট কমিটির সদস্যরা যাচাই ছাড়াই সেই ভুয়া প্রতিবেদনসহ ২৫ কোটি টাকার ঋণের সুপারিশ পাঠান প্রধান কার্যালয়ে। ইউসিবির প্রধান কার্যালয়ের ক্রেডিট কমিটি ঋণ প্রস্তাবে ১৭টি নেতিবাচক পর্যবেক্ষণ থাকা সত্ত্বেও ৪৫৭তম পরিচালনা পর্ষদ সভায় ঋণটি অনুমোদন করে। অর্থাৎ দুর্নীতিপূর্ণ কাগজপত্র ব্যবহার করে একটি নামসর্বস্ব কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ২৫ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়।
এভাবে আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে প্রতারণা, জালিয়াতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন আরামিট গ্রুপ-সংশ্লিষ্ট এক কর্মচারীর আত্মীয়কে মালিক সাজিয়ে, ভুয়া ও মিথ্যা তথ্যসংবলিত কাগজপত্র দাখিল করে ঋণ অনুমোদন করান। পরে সেই অর্থ নগদে উত্তোলন, স্থানান্তর এবং মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে অপরাধজনকভাবে আত্মসাৎ করা হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৪০৬/৪০৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারা, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪(২)(৩) ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এর আগে, ৩০ জুলাই, কাগুজে প্রতিষ্ঠান ‘রিলায়েবল ট্রেডিং’র নামে জাল নথিপত্রে ইউসিবি চট্টগ্রাম পোর্ট শাখা থেকে ১৫ কোটি টাকার ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক মন্ত্রী ও তার স্ত্রীসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
২৪ জুলাই, আরামিট গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীকে মালিক সাজিয়ে ‘ভিশন ট্রেডিং’ নামের প্রতিষ্ঠানের নামে ২৫ কোটি টাকার ভুয়া ঋণ অনুমোদন করিয়ে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ৩১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
১৭ এপ্রিল, অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান ইম্পেরিয়াল ট্রেডিং, ক্লাসিক ট্রেডিং ও মডেল ট্রেডিংয়ের নামে ২০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে সাইফুজ্জামান ও তার স্ত্রীসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা হয়।
এছাড়া আদালতের আদেশে, যুক্তরাজ্যে ৩৪৩টি, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২২৮টি, যুক্তরাষ্ট্রে ৯টি, স্থাবর সম্পদ (বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, জমি) ফ্রিজ ও ক্রোকের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের নামে থাকা ৩৯টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এসব হিসাবে মোট ৫ কোটি ২৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকা রয়েছে। দুদকের আবেদনে তার ১০২ কোটি টাকার শেয়ার ও ৯৫৭ বিঘা জমিও জব্দ করা হয়েছে।
