গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বাংলাদেশ


বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিগত এক বছরে নেওয়া নানা সিদ্ধান্ত শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে এবং সমালোচিত হয়েছে—সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হ্রাসের বিষয়টি। মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, সরকারের নানা পদক্ষেপে সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ সংকুচিত হয়ে পড়েছে, যা গণতন্ত্রের জন্য উদ্বেগজনক সংকেত।
বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকদের অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সংস্থা ‘সিপিজে’ (কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস) গত ১ আগস্ট প্রকাশিত তাদের এক প্রতিবেদনে এই পরিস্থিতির কঠোর সমালোচনা করেছে। তাদের মতে, ‘বাংলাদেশের নেতা তার দেশে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অথচ সেখানে সাংবাদিকরাই আজ জেলবন্দি!’
চলতি বছরের ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে’ (৪ঠা মে) উপলক্ষে ঢাকায় জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেসকো আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ ব্যক্ত করা হয়। এই খাতে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
ইউনেসকো তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ‘ক্রমবর্ধমান সেন্সরশিপ, সাংবাদিকদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ, আইনি হুমকি, নিউজরুমে লিঙ্গ বৈষম্য, সংবাদকর্মীদের ওপর অপরাধ করেও পার পেয়ে যাওয়া – এই ধরনের বিষয়গুলো সত্যিই উদ্বেগের’।
দুজন তৃণমূল পর্যায়ের সাংবাদিক – নোয়াখালির সাইফুল্লা কামরুল ও বরিশালের আখতার ফারুক শাহীন ওই ইভেন্টেই তাদের যে ধরনের হুমকি, হেনস্তা ও পেশাগত বিপদের মধ্যে কাজ করতে হয়, তার বর্ণনা দেন।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে ইউনেসকোর প্রতিনিধি ও কার্যালয় প্রধান ড: সুসান ভিজ বলেন,‘এই সিস্টেমিক ইস্যুগুলো (অর্থাৎ যে সমস্যাগুলো সিস্টেম বা ব্যবস্থার অংশ হয়ে উঠেছে) অ্যাড্রেস করার এবং সাংবাদিকরা ভয়মুক্ত পরিবেশে তাদের কাজ করতে পারবেন এমন একটি ভবিষ্যৎ তৈরি করার সুযোগ এসেছে।’
‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে’-তে প্রকাশিত অপর এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম আট মাসে বাংলাদেশে অন্তত ৬৪০জন সাংবাদিককে নিশানা করা হয়েছে। ১৮২ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের মামলা আনা হয়েছে। ২০৬ জন সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছেন এবং ৮৫ জনের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত শুরু হয়েছে।
সিপিজে’র বাংলাদেশ বিষয়ক প্রতিবেদন
চলতি অগাস্ট মাসের প্রথম দিনে ‘কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস’ যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে, সেটি শুরুই হয়েছে একাত্তর টিভি’র সাবেক সাংবাদিক ফারজানা রূপার পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে। আদালতে তিনি কোনও আইনজীবীর সহায়তাও পাচ্ছেন না। তার জামিনের আবেদনে বিচারকও কর্ণপাত করছেন না।
রূপা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যেই ডজনের ওপর মামলা তার ওপর চাপানো হয়েছে – যেখানে একটা হত্যা মামলাই কোনও সাংবাদিককে ফাঁসানোর জন্য যথেষ্ঠ। একই অভিযোগে তার স্বামীও ওই চ্যানেলের সাবেক হেড অব নিউজ শাকিল আহমেদও আটক রয়েছেন। একাধিক হত্যা মামলায় জেলে বন্দী রয়েছেন বাংলাদেশের আরও দুজন সুপরিচিত সাংবাদিক – শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল হক বাবু।
সিপিজে মন্তব্য করেছে, এই সাংবাদিকদের বিগত আমলের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে মনে করা হতো। কিন্তু শুধু সেই কারণে যে-রকম ঢালাওভাবে তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা পর্যন্ত আনা হচ্ছে সেটা রাজনৈতিক অভিসন্ধিমূলক।
সিপিজে-র আঞ্চলিক অধিকর্তা বেহ লিইহ ওয়াইয়ি মন্তব্য করেছেন, ‘কোনও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই চারজন পরিচিত সাংবাদিককে এক বছর ধরে জেলে আটক রাখার ঘটনা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত অঙ্গীকারকেই দুর্বল করছে।’
সত্যিকারের সংস্কার মানে যে অতীতের খারাপ দৃষ্টান্তগুলো থেকে বেরিয়ে আসার সাহস দেখানো – তাদের নির্যাতনগুলোর পুনরাবৃত্তি নয়, সে কথাও তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন।
শ্যামল দত্তর কন্যা শশী সিপিজেকে জানিয়েছেন, তার বাবার বিরুদ্ধে কতগুলো হত্যা মামলা আনা হয়েছে তারা এখন তার হিসেবও হারিয়ে ফেলেছেন। জানা গেছে, শ্যামল দত্তর পরিবার ছ’টি ও মোজাম্মেল হক বাবুর পরিবার ১০টি হত্যা মামলার বিষয়ে অবগত আছে। রূপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার সিপিজেকে জানিয়েছে, অন্তত পাঁচটি মামলায় তাদের এফআইআরের কপিও দেওয়া হয়নি। ফলে সেগুলোতে তাদের জন্য জামিনের আবেদন করাও সম্ভব নয়।
এই সব অভিযোগের ব্যাপারে সরকারের বক্তব্য জানতে সিপিজের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও পুলিশ বাহিনীর মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই-মেইল করা হয়েছিল, কিন্তু তারা কোনও জবাব দেননি।
গত এক বছরে রাজনৈতিক ইভেন্ট কভার করতে গিয়ে সাংবাদিকরা সহিংসতা ও হেনস্থার শিকার হয়েছেন – সিপিজে এমন অন্তত ১০টি ঘটনাও নথিবদ্ধ করেছে।
‘প্রেস ফ্রিডমের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার হতাশ করেছে’
লন্ডনভিত্তিক ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ গবেষক প্রিয়জিৎ দেবসরকার বলেছেন, তথাকথিত দ্বিতীয় স্বাধীনতার মধ্যে দিয়ে ড: ইউনূসের সরকারের আবির্ভাব।ফলে অনেকেরই প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম হয়ত শৃঙ্খলমুক্ত হবে। কিন্তু সেই জায়গায় চরম হতাশা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি।
তিনি মনে করেওন, ড: মুহাম্মদ ইউনূস নিজে এক সময় যে ডিজিটাল সিকিওরিটি আইনের নিন্দা করেছিলেন, তার আমলেও সেই বিতর্কিত আইনটির প্রয়োগ অব্যাহত আছে। বরং ‘ডিজিটাল সেফটি’র নামে নতুন নতুন বিধিনিষেধ আনা হচ্ছে, যা সংবাদকর্মীদের কণ্ঠরোধ করছে।
গত বারো মাসে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর ঘটে যাওয়া বিভিন্ন হামলার ঘটনাও আন্তর্জাতিক অধিকারকর্মীরা ডকুমেন্ট করেছেন, যা সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। যেমন: ২০২৫ এর মার্চে বরিশাল আদালতের বাইরে খবর করতে গিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে দুজন সাংবাদিক আক্রান্ত হন। রাজধানী ঢাকাতে, এমনকি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির বাইরেও সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে।
গত ১৮ মার্চ একজন নারী সাংবাদিক ঢাকাতে গণধর্ষণের শিকার হন। আর্টিকেল ১৯সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এই ঘটনার কঠোর নিন্দা করেছে।
এপ্রিল মাসে ‘নিউ এজ’ পত্রিকার রাফিয়া তামান্না ও দৈনিক প্রান্তজনের সাজেদুল ইসলাম সেলিমের ওপর শারীরিক হামলা চালানো হয়। ভাঙচুর চালানো হয় দৈনিক প্রথম আলোর রাজশাহী কার্যালয়ে।
সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে সাতক্ষীরাতে কামরুজ্জামান নামে একজন সাংবাদিককে দশ দিনের কারাদণ্ড দেয় মোবাইল আদালত। যদিও তার আসল ‘অপরাধ’ ছিল নিম্ন মানের সরকারি নির্মাণ কাজ নিয়ে রিপোর্ট করা।
ঢাকা মেইলের রুবেল হোসেইনের বিরুদ্ধে জুলাই অভ্যুত্থানের সময় একটি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার মামলা দেওয়া হয়েছে। যদিও তিনি সে সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন না।
এছাড়া দীপ্ত টিভি তাদের সংবাদ সম্প্রচার বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। উপদেষ্টাকে ‘স্পর্শকাতর’ প্রশ্ন করে চাকরি খুইয়েছেন এটিএন বাংলার একজন সাংবাদিক। দুটি ঘটনাতেই অবশ্য সরকার হস্তক্ষেপ করার কথা অস্বীকার করেছে।
