ট্রাম্পের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাপ্রধানের ঘনিষ্ঠতা: ভূরাজনীতিতে নতুন মোড়


পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল অসিম মুনির সম্প্রতি ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে একটি মধ্যাহ্নভোজ সভায় মিলিত হয়েছেন। হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিত এই অনানুষ্ঠানিক বৈঠকটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে নতুন আলোচনা এবং কূটনৈতিক হিসাব-নিকাশের জন্ম দিয়েছে।
বৈঠকটি এমন এক সময়ে হয়েছে, যখন দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং নিরাপত্তা ইস্যু নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। এর মাত্র এক মাস আগে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। বৈঠকের কিছুদিন পর, জুলাইয়ের শেষ দিকে ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের অর্থনীতিকে দুর্বল উল্লেখ করে উচ্চ শুল্ক আরোপ করে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সম্ভাব্য একটি নতুন বাণিজ্য চুক্তির ঘোষণা দেয়। বিশ্লেষকদের মতে, এসব পদক্ষেপ দক্ষিণ এশিয়ায় কূটনৈতিক ভারসাম্যে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে দিক পরিবর্তন
২০১১ সালে পাকিস্তানে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা এবং ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এখন বাণিজ্য, সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা এবং মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে পরামর্শ ভিত্তিক নতুন মিত্রতা গড়ে উঠছে দু’দেশের মধ্যে।
তাছাড়া, পাকিস্তানের কাছে আবারও অস্ত্র বিক্রির চিন্তাভাবনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে দক্ষিণ এশীয় দেশটি প্রায় ৮০ শতাংশ অস্ত্রই চীন থেকে আমদানি করে।
সেনাপ্রধানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক গুঞ্জন
পাকিস্তানে কারাবন্দি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকলেও ভারতের সঙ্গে সাম্প্রতিক উত্তেজনার পর অসিম মুনিরের জনপ্রিয়তা হঠাৎ বেড়েছে।
সেনাবাহিনীর সমর্থনে গঠিত বেসামরিক সরকার পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে, যা সংবিধান পরিবর্তনের পথ খুলে দিয়েছে। ফলে গুঞ্জন উঠেছে, অসিম মুনির প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হতে পারেন, যা হবে পাকিস্তানের ইতিহাসে চতুর্থ সামরিক শাসনের সূচনা।
তবে সামরিক মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী একে ‘সম্পূর্ণ অমূলক’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সেনাপ্রধান কট্টর আদর্শবাদী নন, বরং বাস্তববাদী এবং পশ্চিমা বিশ্বের নীতিমালায় অভিজ্ঞ।
ধার্মিক ও কৌশলী
ইমামের সন্তান অসিম মুনির মাদরাসায় পড়াশোনা করেছেন এবং পুরো কোরআন হিফজ করেছেন, যা তাকে তার পূর্বসূরিদের থেকে আলাদা করে তোলে। তবে সেনাবাহিনীর ভেতরে তিনি প্রায়ই ধর্ম ব্যবসায়ীদের সমালোচনা করেন।
তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্মীয় আবেগ প্রয়োগ করেন না। বরং সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের আধুনিকায়ন কর্মসূচি তার অনুপ্রেরণা।
ভারত ও কাশ্মীর বিষয়ে কঠোর মনোভাব
গত ১৬ এপ্রিল এক বক্তৃতায় তিনি কাশ্মীরকে পাকিস্তানের ‘ঘাড়ের শিরা’ বলে উল্লেখ করেন। ভারতের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে হামলার ছয় দিন আগে এই বক্তব্য দেন পাকিস্তানে সেনাপ্রধান। পাকিস্তান ওই হামলার দায় অস্বীকার করলেও এটি সেনাপ্রধানের আদর্শিক অবস্থান ও সংকল্প প্রকাশ করে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠতা ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক রূপ
ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা অসিম মুনিরকে একটি ভবিষ্যৎ কৌশলগত অবস্থানে নিয়ে গেছে। ট্রাম্পের আশপাশের বিনিয়োগকারী মহল পাকিস্তানের ক্রিপ্টোকারেন্সি ও খনিজ খাতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
একইসঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের দূরল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে সমালোচনা কমিয়ে এনেছে, সহায়তা কার্যক্রম ফের শুরু করেছে এবং সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে অস্ত্র সরবরাহের বিষয়টি বিবেচনা করছে।
তবে এসব অর্জনের বিপরীতে রয়েছে আশঙ্কা ও চ্যালেঞ্জ। পাকিস্তানের দুর্বল বিনিয়োগ পরিবেশ, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ভারসাম্য রক্ষা এবং ভারতের সঙ্গে সংঘাতের ঝুঁকি – সব মিলিয়ে এটি এক উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ ‘হাই-ওয়ার অ্যাক্ট’।
৫৭ বছর বয়সী অসিম মুনির বর্তমানে পারভেজ মোশাররফের পর পাকিস্তানের সবচেয়ে ক্ষমতাবান সেনাপ্রধান। তিনি প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন বা না হন, বর্তমানে তার নেতৃত্বেই পাকিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক কৌশল ও কূটনৈতিক সম্পর্কের দিকনির্দেশনা নির্ধারিত হচ্ছে। তার পছন্দ-অপছন্দ, রাগ বা নমনীয়তা – সবই এখন দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধ ও শান্তির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
