কিশোরী বয়সে গর্ভধারণ কেন ঝুঁকিপূর্ণ? এই সময় যেনো কোনো মা গর্ভধারণ না করে তার করনীয়


অল্প বয়সে গর্ভধারণ বা টিনএজ পেগনেন্সি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ একটি বিষয়। এটি মা ও শিশু দুজনের শরীরের ওপরই বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।
টিনেজ প্রেগন্যান্সি হলো ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সি কিশোরী যখন গর্ভবতী হয়। WHO-এর হিসাব মতে, বিশ্বব্যাপী ১ মিলিয়ন কিশোরী যাদের বয়স ১৫ বছরের নিচে তারা প্রতি বছর বাচ্চা প্রসব করে। UNICEF-এর মতে, তৃতীয় বিশ্বের দেশে প্রতি ৫ জন শিশুর মধ্যে ১ জন জন্ম নেয় কিশোরী মাতার গর্ভে। এ বয়সি কিশোরী শারীরিক ও মানসিকভাবে মাতৃত্বের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত নয়। যখন একজন কিশোরী মা হয় তখন এর প্রভাব পড়ে শরীর, আবেগ, সামাজিক জীবনের ওপর। এর জটিলতা হিসাবে মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, সময়ের আগে জন্ম নেওয়া শিশু, অল্প ওজনের শিশু, যৌনরোগ দেখা দিতে পারে।
টিনএজ প্রেগনেন্সি বলতে আমরা যা বুঝি আসলে এর অর্থ হলো অল্প বয়সে গর্ভধারণ করা। আন্তর্জাতিকভাবে যারা ২০ বছরের নিচে গর্ভধারণ করবে, তাদের টিনএজ প্রেগনেন্সি বলা হয়। কিন্তু আমাদের দেশের জন্য যেটা বলা হয় ১৮ বছরের নিচে, যেই গর্ভধারণ হয় বা যেসব মায়েরা গর্ভধারণ করে থাকে, তাদের আমরা টিনএজ প্রেগনেন্সি বলি।
কিশোরী বয়সে গর্ভধারণ এটি খুব ঝুঁকিপূর্ণ,সে জন্য এখানে টিনএজ (বয়ঃসন্ধি) প্রেগনেন্সি বলা হচ্ছে। এই গর্ভাবস্থার অনেক অনেক ধরনের ঝুঁকি রয়েছে।
প্রথমত বলি, বয়ঃসন্ধিকালের গর্ভধারণ কী ধরনের ঝুঁকি তৈরি করে। প্রথমত দেখুন যে একটি বাচ্চা মেয়ে, তার যখন খেলার বয়স, তখন তার বিয়ে তো হলোই, এরপর একটি দায়িত্বের মধ্যে পড়ল, এরপর আবার গর্ভধারণ। গর্ভধারণ মানে তার সমস্ত শরীরে একটি পরিবর্তন। তখন দেখা গেল, যেই মেয়েটি হয়তো পড়াশোনা করছে, তার হয়তো বিভিন্ন রকম উপসর্গ শুরু হলো। প্রথম থেকেই তো বিভিন্ন রকম উপসর্গ হয়। এতে কী হলো পড়াশোনা কিন্তু সে করতে পারল না। পড়াশোনা সে নিয়মিত করতে পারছে না।
এরপর দেখুন চাকরির ব্যাপারে। পড়াশোনা যদি নাও করে থাকে, অনেক পোশাক কারখানার মেয়েরা আছে, যারা সেখানে কাজ করে, আরো অনেকে আছে যারা হয়তো ছোটখাটো চাকরি করে, সেখান থেকে তাকে বের হয়ে চলে আসতে হলো। সেই ক্ষেত্রে তার হয়তো পড়াশোনা হলো না, চাকরিচ্যুত হলো। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো তার শরীরের ওপর প্রভাব পড়ে।
যখন একটি মেয়ে গর্ভধারণ করে, সে যদি খুব কম বয়সে গর্ভধারণ করে দেখা যায় তার শরীরের নিজস্ব যে বৃদ্ধি সেটিই কিন্তু পরিপূর্ণ হয় না। তার যে পথ দিয়ে বাচ্চা হবে, মনে করেন, প্যালভিস, সেটিই কিন্তু তার তৈরি হয় না। প্যালভিস যদি ভালোভাবে তৈরি না হয়, একটি বাচ্চা যখন প্রসব হবে তখন প্যালভিসের মধ্যে আটকে যায়। যেহেতু তার পথ তৈরি হয় না, আগে থেকে যদি কোনো পদক্ষেপ তৈরি করা না হয়, তাহলে সে পথে সে আটকে যাবে। যেহেতু মায়ের নিজেরই গঠনগতভাবে শরীর তৈরি হয় না, তাই বাচ্চা বের হওয়ার যে পথ সেখানে শেষ পর্যন্ত বাচ্চাটা আটকে যায়। আটকে গেলে কী হয়? মায়ের জরায়ু ফেটে যাবে। রক্তপাত হয়ে মা মারাও যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত হয়তো দেখা যাবে বাচ্চা পেটের মধ্যে মারা যাবে। তাহলে দেখুন মা বা বাচ্চা দুজনের জন্যই বিষয়টি ঝুঁকির। এরপর কী হয়, মায়ের যেহেতু নিজস্ব পুষ্টি হয়নি, তার রক্তশূন্যতা থাকবে। এতে বাচ্চাও হয়তো রক্তশূন্য হবে। যেহেতু বাচ্চা পুষ্টি পাচ্ছে না, রক্তশূন্যতা হয়, তাই আগে আগে বাচ্চাটি প্রসব হয়।
অল্প ওজন নিয়ে অনেক বাচ্চা জন্মগ্রহণ করে, এর একটি বড় কারণ বয়ঃসন্ধি গর্ভাবস্থা। এসব শিশুরর অপুষ্টিজনিত সমস্যা থাকে। তার ওজন ঠিকমতো হয় না। কিশোরী বয়সে মেয়েদের বিয়ে হলে শিশু জন্মের পর তাদের নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে।
মনে করেন একটি মা অল্প বয়সে বাচ্চা জন্ম দিল, বাচ্চাটি ওজন কম নিয়ে জন্মগ্রহণ করল, সেই বাচ্চাটি যখন আবার নিজে গর্ভধারণ করবে, পরে গিয়ে সেও অপুষ্টিতে ভুগবে। এরকম করে একটি চক্র, একটি জেনারেশন পুষ্টি থেকে বাইরে চলে গেল। এরা সবাই কিন্তু পুষ্টিহীনতায় ভুগছে।
এই সময় যেন কোনো মা গর্ভধারণ না করে, সে জন্য কোন কোন বিষয় মাথায় রাখা উচিত?
সবচেয়ে প্রথমে আমাদের সমাজকে সচেতন হতে হবে। ১৮ বছরের নিচে কোনো একটি পরিবার যদি মেয়েকে বিয়ে দেয়, সেটা একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। তাহলে প্রথমে সচেতনতা সবার ভেতরে তৈরি করতে হবে। যেহেতু আমাদের দেশে বেশির ভাগ মানুষ গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে, তাদেরও বিভিন্নভাবে বোঝাতে হবে। কর্মী দিয়ে হোক বা টেলিভিশন –যেসব মিডিয়া আছে সেগুলো তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে।
একটি পরিবারে যদি বাবা-মা জানেন তাঁর মেয়ে এ রকম একটি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে, নিশ্চয়ই তিনি চাইবেন না, তার মেয়েটি বা বাচ্চাটি সে রকম ঝুঁকিতে যাক। কাজেই এই সচেতনতা তৈরি করতে হবে। এরপর আমাদের তাকে শিক্ষা দিতে হবে। শিক্ষা একটি বড় ব্যাপার। একটি মেয়ে যদি শিক্ষিত হয়, পরিবার যদি শিক্ষিত হয়, শিক্ষার কারণে সে কিন্তু সবকিছু জানবে। তখন সে কিন্তু মেয়েটাকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চাইবে না। এর মানে তার শিক্ষা লাগবে এবং যৌন শিক্ষা লাগবে। কেবল মাত্র গর্ভধারণ কেন, এর আগে যদি কেউ সেক্সুয়াল প্র্যাকটিস করে সেটিও কিন্তু অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। তার বিভিন্ন রকম ক্যানসার হতে পারে।
একটি মেয়ের যে জরায়ুমুখের ক্যানসার হয়, এর একটি বড় কারণ কিন্তু অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার পর ইন্টারকোর্সে যাওয়া। তাই এটা কিন্তু বিরাট বড় একটি ব্যাপার। এরপর তার গর্ভধারণ। গর্ভধারণ হলে তার কত রকম সমস্যা। সেটা তো বুঝতে হবে তাই না? সেক্ষেত্রে সচেতনতা, শিক্ষা, যৌনশিক্ষা, অনেক বড় ভূমিকা পালন করে।
লেখক,
ডা.ফারহানা ইয়াছমিন
স্ত্রী রোগ ও প্রসূতিবিদ্যা চিকিৎসক ও সার্জন
এক্স এইচ.এম.ও, সদর হাসপাতাল ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
