নকল ‘সিগমা’ লিফটে গ্রাহক প্রতারিত, বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি


বিশ্ববিখ্যাত লিফট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান Otis Elevator Company, USA-এর ‘SIGMA’ ব্র্যান্ড ও লোগো অবৈধভাবে ব্যবহার করে বাজারে ছড়ানো হচ্ছে নকল ও নিম্নমানের লিফট। এতে প্রতারিত হচ্ছেন অসংখ্য গ্রাহক ও ভবন মালিক, বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি—তবে অজ্ঞাত কারণে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো নীরব।
‘SIGMA’ লিফটের বাংলাদেশে একমাত্র অনুমোদিত পরিবেশক খান ব্রাদার্স ইক্যুবিল্ড লিমিটেড অভিযোগ করে জানিয়েছে, বাজারে বর্তমানে কিছু অসাধু প্রতিষ্ঠান নকল SIGMA লিফট সরবরাহ করছে। এসব প্রতিষ্ঠান মূল ব্র্যান্ডের লোগো ও ট্রেডমার্ক ব্যবহার করে গ্রাহকদের বিভ্রান্ত করছে, অথচ পণ্যগুলোর মান ও উৎস সিগমা বা ওটিস কোম্পানির সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পর্কিত নয়।
খান ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তোফায়েল কবির খান জানান, “আমরা বিগত ৩৫ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে সিগমা ব্র্যান্ডের লিফট সরবরাহ করে আসছি। সিগমা এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত একটি ব্র্যান্ড, যার একমাত্র অথোরাইজড ডিস্ট্রিবিউটর বাংলাদেশে আমরা। অথচ কিছু প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে আমাদের ট্রেডমার্ক ব্যবহার করে গ্রাহকদের প্রতারিত করছে।”
তদন্তে জানা গেছে, প্রতারক চক্র নিম্নমানের মোটর, মাদারবোর্ড, ডোর ড্রাইভ, কন্ট্রোলার এবং স্টিলের খোলস ব্যবহার করে দেশে লিফট প্রস্তুত করছে। পরে এগুলোর উপর SIGMA লোগো লাগিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে। এগুলোর কোনো যন্ত্রাংশই সিগমার কারখানা থেকে আসেনি এবং আন্তর্জাতিক মানও মানা হচ্ছে না।
এমনকি অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় ওয়ার্কশপে তৈরি যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে ভবন মালিকদের নিকট দামি মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে ব্যবহারে ঝুঁকি বাড়ছে, ঘটছে দুর্ঘটনাও।
খান ব্রাদার্স ইক্যুবিল্ড লি. ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে একাধিকবার লিখিত অভিযোগ দিলেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুস সালাম গত ১১ ফেব্রুয়ারি বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে ২৩ ফেব্রুয়ারি শুনানির জন্য নোটিশ পাঠান। কিন্তু অভিযোগকারী হাজির থাকলেও অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিজেই অনুপস্থিত ছিলেন—যা ভোক্তাদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে।
নকল SIGMA লিফট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে:
১. বাংলাদেশ বিল্ডিং অটোমেশন, মালিবাগ, ঢাকা
২. সিগমা এলিভেটর বাংলাদেশ লিমিটেড, দক্ষিণখান, ঢাকা
৩. সিগমা লিফট লিমিটেড, কারওয়ান বাজার, ঢাকা
৪. ক্রেস্ট লিফটস লিমিটেড, মগবাজার, ঢাকা
৫. সিটি পাওয়ার লিফট, পূর্ব নামাপাড়া, ঢাকা
৬. সিগমা লিফট বিডি, মিরপুর, ঢাকা
৭. সিগমা লিফট সাংহাই, অনলাইন ভিত্তিক সরবরাহকারী
৮. আজিজ লিফট টেকনোলজি লিমিটেড, মহাখালী, ঢাকা
বিশেষজ্ঞদের মতে, উচ্চ ভবনের জন্য লিফট শুধুমাত্র বিলাসিতা নয়, বরং একটি জীবনরক্ষাকারী ব্যবস্থা। নিম্নমানের যন্ত্রপাতি দিয়ে তৈরি এসব ভুয়া লিফটে যাত্রীরা প্রতিনিয়ত ঝুঁকির মধ্যে থাকছেন। এসব লিফটে ঘটছে যান্ত্রিক গোলযোগ, আটকে পড়া, এমনকি প্রাণহানির মতো ঘটনাও।
খান ব্রাদার্সের দাবি, বিষয়টি শুধুমাত্র ব্যবসায়িক স্বার্থের বিষয় নয় এটি জননিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রত্যয়নপত্রসহ প্রমাণাদি জমা দিয়েও কার্যকর ব্যবস্থা পাননি তারা।
তোফায়েল কবির খান বলেন, “আমি একজন ব্যবসায়ী হিসেবে নয়, একজন নাগরিক হিসেবে চাই—প্রতারণাকারীদের দমন হোক এবং গ্রাহকদের সুরক্ষা নিশ্চিত হোক।”
‘SIGMA’ একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ব্র্যান্ড হলেও বাংলাদেশের বাজারে এর নামে প্রতারণা ও জালিয়াতি আজ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে দেশের সাধারণ জনগণ যেমন প্রতারিত হচ্ছেন, তেমনি ঝুঁকিতে পড়ছে ভবন নিরাপত্তাও। এখনই জরুরি পদক্ষেপ না নিলে সামনে আরও বড় বিপর্যয় অনিবার্য।
