বয়স নয়, দরকার ইচ্ছাশক্তি: ৬৪ জেলা ভ্রমণে শিক্ষক-দম্পতি


পঞ্চাশ পার করা মানুষটি যখন গ্রাম্য স্কুলে পড়ান, তখন কেউ ভাবেওনি—তিনি একদিন হয়ে উঠবেন বাংলাদেশের পথের খুঁজে বেরিয়ে পড়া এক যাত্রী। তাজুল ইসলাম, নাটোরের সিংড়ার প্রত্যন্ত গ্রামের শিক্ষক, জীবনের নতুন মানচিত্র এঁকেছেন স্ত্রীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে। শহর থেকে শহর, জেলা থেকে জেলা—মোটরসাইকেলে চেপে একে একে ঘুরে ফেলেছেন দেশের ৬৪টি জেলা। তাদের এই যাত্রা শুধু স্থানভিত্তিক নয়—এ ছিল ভালোবাসা, সাহস আর নতুন স্বপ্ন খোঁজার সফর।
নাটোরের সিংড়া উপজেলার বিলদহর গ্রামের বাসিন্দা তাজুল ইসলাম পেশায় একজন শিক্ষক। তিনি ১৯৯০ সালে মহিষমারী দাখিল মাদরাসায় যোগ দেন এবং এখনো সেখানেই কর্মরত। পরিবারে আছেন স্ত্রী ফেরদৌসী বেগম ও তিন সন্তান। বড় ছেলে তারিকুল ইসলাম শুভ একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। মেঝো ছেলে তাসনিমুল ইসলাম সুপ্ত কাজ করছেন যশোর টেকনোলজি পার্কে, আর ছোট মেয়ে তানজিমা ইসলাম সুচি কলেজে পড়েন।
জীবনের নানা ব্যস্ততা আর দায়িত্বের মাঝেও তাজুল ইসলাম নিজেকে গুটিয়ে রাখেননি। বরং খুঁজে নিয়েছেন নিজের স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখার উপায়। দেশকে ঘুরে দেখতে বেঁছে নিয়েছেন বাইক ভ্রমণ।
২০১৬ সালে গুরুতর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে তাজুল ইসলামের ওপেন হার্ট সার্জারি হয়। তখন থেকেই জীবন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। মৃত্যুর কাছাকাছি গিয়েও ফিরে আসার অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছে জীবন একটাই। অপারেশনের পর ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়েন যমুনা সেতু পেরিয়ে। সেই যাত্রাই ছিল তার ঘুরে বেড়ানোর সূচনা।
পরের কয়েক বছরে একে একে ঘুরে ফেলেছেন ঢাকা বিভাগের সব জেলা। এরপর ২০২২ সালে চট্টগ্রাম বিভাগ, ২০২৩ সালে রাজশাহী ও ময়মনসিংহ, ২০২৪ সালে বরিশাল ও রংপুর এবং সর্বশেষ ২০২৫ সালে খুলনা বিভাগও ঘুরে শেষ করেছেন। এসব ভ্রমণে তিনি একা যাননি। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়েই বাইকে পাড়ি দিয়েছেন দুরূহ পথ। এমনকি দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে তিনি পৌঁছেছেন রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও সাজেকেও।
একটি ডিসকভার ১০০ সিসি মডেলের বাইকে চেপেই পুরো দেশ ঘুরে দেখেছেন তাজুল ইসলাম। ছুটি পেলেই ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি। কখনো বরিশাল, কখনো কুড়িগ্রাম, আবার কখনো পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে খাগড়াছড়ি। তার চোখে এ ভ্রমণ শুধু স্থান দেখার জন্য নয় বরং জীবনকে নতুনভাবে বোঝার জন্য।
তার এই অদম্য সাহস দেখে বিস্মিত হয়েছেন পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং এলাকার মানুষ। তার ছেলে তাসনিমুল ইসলাম সুপ্ত বলেন, আমি শুধু গর্বিত নই, কৃতজ্ঞও। আমার বাবা আমাদের শেখান জীবন মানে কেবল বয়স নয়, জীবন মানে ইচ্ছাশক্তি। আমার বাবার এই ভ্রমণ তার একার নয়, এটা আমাদের সকলের প্রেরণার গল্প হয়ে উঠেছে।
তাজুল ইসলামের স্বপ্ন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বাইকে ভারত, নেপাল ও ভুটান ঘুরে দেখা। তিনি মনে করেন, সীমান্ত শুধু মানচিত্রেই থাকে, ইচ্ছাশক্তির কোনো সীমান্ত নেই।
তাজুল ইসলাম বলেন, আমি কাউকে দেখানোর জন্য ঘুরি না। নিজের জন্য, নিজের শান্তির জন্য ঘুরি। বাইক আমার মুক্তির চাবিকাঠি। আমি মানুষের মুখ দেখি, প্রকৃতির রূপ দেখি, জীবন দেখি। বাধা আসে মন থেকে, বয়সটা কখনই বাধা নয়।
দৈএনকে/জে, আ
