বিএনপিকে টার্গেট করে উত্তেজনা: বিচার নয়, রাজনীতি মুখ্য?


সম্প্রতি রাজধানীর মিটফোর্ড এলাকায় এক ব্যবসায়ী হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে অনুষ্ঠিত একটি বিক্ষোভে “বিএনপি, চাঁদাবাজ; চাঁদা তোলে পল্টনে, ভাগ যায় লন্ডনে” এই ধরনের স্লোগান দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, ‘আমার ভাই খুন কেন, তারেক রহমান জবাব দে’, ‘বিএনপি জ্বালোরে জ্বালো আগুন জ্বালো’ এমন স্লোগানও উচ্চারিত হয়েছে।
এই কর্মসূচিতে কারা অংশ নিয়েছে, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় বা উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে: বিচারের দাবির বদলে রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বকে টার্গেট করা হচ্ছে কেন?
সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডগুলোর প্রেক্ষাপটে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, প্রকৃত অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনার দাবি নেই বললেই চলে। বরং বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি ও এর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ঘিরেই উত্তেজনা ও প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপিকে কেন্দ্র করে এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি রাজনৈতিক কৌশলেরই অংশ। কারণ মিটফোর্ডের হত্যার বিচার বা অপরাধীদের শনাক্ত করার কার্যকর কোনো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ না থাকলেও, প্রতিবাদকারীরা সরাসরি বিএনপিকে দায়ী করছেন। যার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট।
ক্ষমতাসীনদের শাসনামলে সবচেয়ে আঘাতপ্রাপ্ত বিএনপি?
২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা সাবেক স্বেরাচার আওয়ামী লীগের সময়কালে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হয়েছে বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। গুম, খুন, রাজনৈতিক মামলা, হামলা, দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি, সব ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েও বিএনপিই সবচেয়ে বেশি রাজপথে সক্রিয় থেকেছে। ওয়ান-ইলেভেন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত জিয়া পরিবারকে কেন্দ্র করে লাগাতার দমনমূলক কৌশল চালিয়েছে সাবেক স্বেরাচার হাসিনার সরকার। খালেদা জিয়ার দীর্ঘকালীন কারাবাস ও অসুস্থতা, তারেক রহমানের নির্বাসন, শীর্ষ নেতৃত্বে গ্রুপিং সবই বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করেছে।
চাঁদাবাজি ও সহিংসতায় বিএনপি-নির্ভরতা: সত্য নাকি প্রচার?
৫ আগস্টের পর চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের অভিযোগে বিএনপির নামই বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। বিএনপি’র তৃণমূল শক্তিশালী হওয়ায় অনেক সময় ব্যক্তিকেন্দ্রিক অপকর্মে দলটির নাম সামনে আসছে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, এই অভিযোগগুলো কতটা প্রমাণিত? প্রতিপক্ষ বলছেন, ক্ষমতা না থাকলেও বিএনপি নিজের কর্মীদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। তবে বিএনপি-সমর্থকরা বলছেন, প্রকৃত অপরাধীরা ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় থাকায় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হচ্ছে না।
সাবেক স্বৈরাচার সরকার প্রধান শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেছেন এমন অভিযোগ বহুদিন ধরেই চলছে। ব্যাংক লুট, দুর্নীতি, তৃণমূল চাঁদাবাজি, প্রতিপক্ষ দমন, সব ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগের ভূমিকা ছিল কেন্দ্রীয়ভাবে নির্দেশিত। অন্যদিকে, বিএনপির নেতিবাচক কর্মকাণ্ড দলীয় পর্যায়ে নয়, বরং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভঙ্গুরতার ফলে ঘটছে বলে অনেকে মনে করেন।
কী হবে বিএনপিকে টার্গেট করে চললে?
একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলকে একতরফাভাবে দোষারোপ করলে, তা গণতন্ত্রকে দুর্বল করে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রতিপক্ষের অস্তিত্ব নিশ্চিত করা জরুরি। বিএনপি যদি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়, তাহলে অন্য বিরোধী দল, এমনকি ক্ষমতাসীনদের মধ্যেকার গ্রুপও এক সময় ক্ষতির মুখে পড়বে।
সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে, খুলনায় বিএনপি-ঘনিষ্ঠ যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমানকে গুলি করে হত্যা করা হয়, যা প্রায় আড়ালে পড়ে গেছে। এর বিচারের দাবিতে যতটা না আওয়াজ উঠেছে, মিটফোর্ডে একটি হত্যাকে ঘিরে বিএনপিকে দায়ী করেই উত্তেজনা বাড়ানো হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক অস্থির, ষড়যন্ত্রপ্রবণ ও গণতন্ত্রহীন ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তাহীনতা, নেতৃত্বহীনতা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার দায় শুধু বিএনপির নয়, রাষ্ট্রেরও। বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে ঢেকে রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালানো হলে একদিন হয়তো সবাই-ই মাইনাস হবে, বিএনপি, তারেক রহমান, এমনকি বর্তমান ক্ষমতাসীনরাও।
