প্রাচীন মহাভারতের জলপত্রে যার উন্মেষ, আজ তা ফুচকা!


ফুচকা!—শব্দটি উচ্চারণ করলেই যেন জিভে জল চলে আসে। সুজি ও ময়দা দিয়ে তৈরি ছোট, মুচমুচে গোল আকৃতির ভিতরে ভরা হয় মসলা মেশানো আলু, সঙ্গে টক, ঝাল, মিষ্টি মসলা আর তেঁতুল পানি। মুখে দিলেই এক অনন্য স্বাদের বিস্ফোরণ ঘটে—যা ভাষায় প্রকাশ করা সত্যিই কঠিন। ছোট থেকে বড়—সব বয়সী মানুষের কাছেই এই স্ট্রিটফুড অত্যন্ত প্রিয়।
তবে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের কাছে ফুচকা বেশি জনপ্রিয় বলে জানা যায়। কারো কারো মান-অভিমানের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে ফুচকা। এই ফুচকা দিয়েই শুরু হয় হাজারো তরুণ-তরুণীর প্রেমের গল্প। কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছেন কি ফুচকার উৎপত্তি কোথায়? কীভাবে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে ফুচকা?
ফুচকার উৎপত্তি জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই পৌরাণিক যুগের মহাভারতে। যাতে রয়েছে হাজার হাজার বছরের ইতিহাস। কথিত আছে পঞ্চপাণ্ডবের নববধু দ্রৌপদী যখন শ্বশুরবাড়ি আসে। তখন রান্নাভার দ্রৌপদীর ওপর পড়ে। তখন পঞ্চপাণ্ডবের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল না। কারণ তখনো তারা বনবাসে ছিলেন।
অর্থনৈতিক দুরবস্থায় পঞ্চপাণ্ডব মাতা কুন্তি, দ্রৌপদীকে এক রান্নার পরীক্ষা দেন। পঞ্চপাণ্ডব মাতা কুন্তি আগের দিনের বেঁচে যাওয়া আলু, সবজি ও সামান্য কিছু ময়দা দিয়ে বলেন, ‘এমন খাবার বানাও যাতে সবাই ভরপেট খেতে পারে’। রাঁধুনী দ্রৌপদী তখন আবিষ্কার করেন এক নতুন খাবারের। যেটি মহাভারতের জলপত্র নামে অবহিত করা হয়েছে। যা আজকের দিনে আমাদের কাছে ফুচকা হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে।
যদিও প্রাচীন গ্রীসের পর্যটক মেগাস্থিনিসের লেখা ‘ইন্ডিকা’ বইয়ের পাতায়ও ফুচকার হদিস পাওয়া যায়। যা মহাভারতেরই সমসাময়িক সময়ে লেখা। তবে কোথাও কোথাও লেখা আছে ফুচকার উৎপত্তি প্রাচীন ভারতের মগধ রাজ্যে। ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বর্তমানে যেটি এখন পশ্চিম-মধ্য বিহার, যা এককালে গঙ্গানদীর তীরে মগধ সাম্রাজ্য ছিল। আবার এই মগধ রাজ্যই ছিল দ্রৌপদীর জন্মস্থান। তাই মগধ রাজ্যই যে ফুচকার উৎপত্তি স্থল তা বলাই যায়।
তবে ভারতীয় রন্ধন বিশেষজ্ঞ কুরুশ দালালের মতে, উত্তর ভারতেই প্রথম প্রচলন হয়েছিল জনপ্রিয় এই মুখরোচক খাবারের। রাজ কচুরি থেকে বিবর্তিত হয়ে এই খাবার উৎপত্তি হয়েছে। এরপর ভারতীয় মানুষ জীবিকার তাগিদে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গেলে পুরো ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। তবে ১৯৪৭ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে ফুচকার প্রচলন ছিল না।
যদিও স্থান-কাল ভেদে ফুচকার রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নাম। ফুচকা বানানোর ধরনেও এসেছে বৈচিত্র্যতা। পাকিস্তান এবং ভারতের নয়াদিল্লি, জম্মু-কাশ্মীর, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও হিমাচল প্রদেশে এর নাম গোলগাপ্পা। আবার তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্রে এর নাম হয়েছে পানিপুরি। আবার শ্রীলঙ্কা, নেপালে এর নাম হয়েছে ফুলকি।
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশে তা ফুচকা নামেই বেশ জনপ্রিয়। পরিবেশনেও বেশ বৈচিত্রতা লক্ষ্য করা যায়। কেউ শুধু ঘুগনির সঙ্গে মিষ্টি তেঁতুল পানি দিয়ে ফুচকা বিক্রি করেন। কেউ কেউ দই ফুচকা সঙ্গে চানাচুর দিয়ে আলাদা এক স্বাদের মেলবন্ধন করেছেন। কেউবা নানা রকমের বাহারি মসলা নিয়ে ফুচকা বিক্রি করেন। এই ফুচকার মধ্যেও রয়েছে নানা গোত্র। ভেলপুরি তাদের মধ্যে একটি। যা ফুচকার তুলনায় কিছুটা বড় হয়। এছাড়াও স্বাদের দিক থেকেও রয়েছে ভিন্নতা।
স্থান কাল ভেদে নাম, পরিবেশনগত রীতিনীতিতে ভিন্নতা থাকলেও হাজার হাজার বছর ধরে ফুচকা এখনো মানুষের মাঝে বেশ জনপ্রিয়। একটা সময় মাত্র এক টাকায় একটি ফুচকা পাওয়া যেত। সময়ের বিবর্তনে ফুচকার দামেও ভিন্নতা এসেছে। তবে এর জনপ্রিয়তা আগের মতোই বহাল রয়েছে।
এখন সর্বনিন্ম ৩০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০ টাকার ফুচকা পর্যন্ত পাওয়া যায়। স্ট্রিট ফুড ফুচকার জনপ্রিয়তা তাকে রেস্টুরেন্টে পর্যন্ত নিয়ে গেছে। তবে সবাই ফিরে আসে সেই রাস্তার দোকানের ফুচকা বিক্রেতা মামার কাছে। ছুটির দিনে কিংবা কোনো উৎসবে ছোট ছেলে মেয়ে, তরুণ তরুণীরা ছুটে চলে যায় সেই ফুচকা ওয়ালা মামার কাছে। ফুচকা যেন তাদের এক আবেগের জায়গা।
দৈএনকে/ জে. আ
