শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫
Natun Kagoj

রায়েরকাঠি জমিদার বাড়ি: শাহজাহান আমলের স্থাপত্যের সাক্ষী

রায়েরকাঠি জমিদার বাড়ি: শাহজাহান আমলের স্থাপত্যের সাক্ষী
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

ঐতিহাসিক পিরোজপুরের রায়েরকাঠি জমিদার বাড়ি ৪৫০ বছরের পুরোনো ইতিহাসের সাক্ষী । ভারতবর্ষের মোঘল সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে ১৬০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে নির্মিত হয় এই জমিদার বাড়ি। ঐতিহাসিক এই স্থাপনা দেখতে আসেন অসংখ্য পর্যটক।

প্রায় ২০০ একর জমি নিয়ে অপূর্ব নির্মাণশৈলীর এ প্রাসাদ ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভাটিয়াল রাজা রুদ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী। বিস্তৃত এই বাড়িতে নির্মাণ করা হয় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ২০০টি ভবন। ইট-সুঁড়কি দিয়ে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তৈরি করা হয় রাজবাড়ির প্রাসাদ ও মঠগুলো। এরই একটি মঠে স্থাপন করা হয়েছে ২৫ মণ ওজনের বিশালাকার একটি শিবলিঙ্গ। কষ্টি পাথরের তৈরি এ মহামূল্যবান শিবলিঙ্গটি উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় শিবলিঙ্গ বলে জনশ্রুতি আছে।

রাজা রুদ্র নারায়ণ হুগলির দে গঙ্গায় এক ব্রাহ্মণ বাড়ির রাখাল ছিলেন। সেখানে সম্রাট জাহাঙ্গীর একদিন গঙ্গা দিয়ে যাওয়ার সময় রাজা রুদ্র নারায়ণকে দেখতে পান। তখন রাজা রুদ্র নারায়ণ শিশু, সম্রাট জাহাঙ্গীরের চোখে পড়েন তিনি। সম্রাট রাজা রুদ্র নারায়ণকেই এই অঞ্চলের জমিদার ঘোষণা করেন। বাংলার এই অঞ্চলে রাজা রুদ্র নারায়ণের হাতেই সম্রাট জাহাঙ্গীর জমিদারি প্রথা শুরু করেন।

৪৫০ বছরের পুরোনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও কালের বিবর্তনে তা এখন ধ্বংস হতে চলেছে। মঠ এবং পুরোনো জমিদার বাড়িটির অবস্থা ভুতুড়ে। চরম অবহেলা ও সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ না থাকায় ঐতিহাসিক এই রাজবাড়ির মূল্যবান পুরাকীর্তিগুলো এখন ধ্বংস হতে চলেছে। কালের স্বাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সুউচ্চ ১১টি মঠ।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলসহ দেশের বাইরে থেকেও পর্যটকরা আসেন এখানে। যদিও তারা এসে শুধুই আস্তরণ খসে পড়া কিছু পুরোনো বাড়ি দেখতে পান। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ইতিহাসের এই নিদর্শন হারিয়ে যেতে বসেছে।সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ না করলে হারিয়ে যেতে পারে ঐতিহাসিক এই স্থাপনা।

স্থানীয়দের দাবি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ যদি এই ঐতিহাসিক স্থাপনার রক্ষণাবেক্ষণ করে তাহলে যুগের পর যুগ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ থেকে অনেক কিছু জানতে পারবে। সরকারিভাবে দেখভাল করলে গড়ে উঠতে পারে পিরোজপুরের অন্যতম বৃহৎ পর্যটক কেন্দ্র। যেখান থেকে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

রাজা রুদ্র নারায়ণের ১২তম প্রজন্ম অপূর্ব রায় চৌধুরী বলেন, ‘এটি ঐতিহ্যবাহী পিরোজপুরের জমিদার বাড়ি। সাড়ে চারশো বছর আগে রাজা রুদ্র নারায়ণের হাত ধরে এখানে জমিদারির প্রথা শুরু হয়েছিল। বর্তমানে আমরা এখানে দুটি পরিবার রয়েছি, বাকি সবাই ওপার বাংলায় চলে গেছে। এখানে প্রায় সব কিছুই ধ্বংসপ্রাপ্ত, কিছু মন্দির আছে, দিঘি আছে, ভাঙা বাড়ি আছে। এখনো যদি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এগিয়ে আসে সরকারের মাধ্যমে যতটুকু ভাঙাচোরা আছে, মন্দির, পাঠশালা, অতিথিশালা সহ অন্যান্য যা আছে এগুলো রক্ষা করা সম্ভব।’

তিনি জানান, ‘রাজা রুদ্র নারায়ণ হুগলির দে গঙ্গায় এক ব্রাহ্মণ বাড়ির রাখাল ছিলেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর একদিন গঙ্গা দিয়ে তার বজরা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন সম্রাট জাহাঙ্গীরের চোখে পড়েন রাজা রুদ্র নারায়ণ। ডেকে পাঠানো হয় তাকে। এরপর সম্রাট জাহাঙ্গীর রাজা রুদ্র নারায়ণকে বললেন, তোমাকে জমিদারি দেওয়া হবে। যদিও রাজা রুদ্র নারায়ণ তখন শিশু। এরপর সম্রাট জাহাঙ্গীর তার লোকজন দিয়ে রাজা রুদ্র নারায়ণকে দিয়ে এই অঞ্চলে জমিদারি প্রথা শুরু করলেন। রায়েরকাঠি জমিদার বাড়ি এলাকা এক সময় সুন্দরবনের অঞ্চল ছিল। দিনের বেলায় বাঘ ঘুরে বেড়াত।’

এখানে দাতব্য চিকিৎসালয় ছিল, প্রায় ৩০০ বছর আগে এখানে হাই স্কুল, পাঠশালা ছিল, আরও ছিল ঘোড়াশালা, হাতিশালা। জমিদারি প্রথা চালু করতে গেলে যা যা প্রয়োজন ছিল সবকিছুই এখানে ছিল।

এখানে অনেক স্থাপনা রয়েছে তার ভেতরে অন্যতম হচ্ছে শনি মন্দির, যেটা প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো। এখানে শনি দেবের পূজা অর্চনা করা হতো। হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় পূজা দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হতো। পূজার জন্য ঠাকুর এবং বাজনদার‌ সবকিছুই কলকাতা থেকে আসতো সেই আমলে। তখন হুলারহাট বান্দর ছিল সবথেকে নামকরা বন্দর। কলকাতা ভিত্তিক চলাফেরা ছিল হুলারহাট বন্দর থেকে।

রোজ অন্তত এক থেকে দেড়শত লোক এখানে দেখতে আসে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। আমার মনে হয় ৬৪ জেলার কোন জেলায় বাকি নেই এই ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখতে। গতকালকেও টাঙ্গাইল থেকে এসেছে এই স্থাপনা দেখতে। আমরা চাই অনতিবিলম্বে সরকারের হাত ধরে এখানে একটি পর্যটক কেন্দ্র হোক। দেশ-বিদেশের লোকজন আসুক এবং ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখুক। পুরোনো ঐতিহ্যটা কিরকম ছিল সেটা দেখুক। তাদের কালচার কেমন ছিল, তাদের বিচার ব্যবস্থা কেমন ছিল সবকিছুই দেখুক। এগুলো নতুন প্রজন্ম দেখলে অনেক কিছু শিখতে পারবে এবং জানতে পারবে।

স্থানীয় বাসিন্দা সোলায়মান শেখ বলেন, ‘এটি ঐতিহ্যবাহী রায়ের কাঠি জমিদার বাড়ি। এখানে প্রায় ১১ টি মঠ আছে, যার অধিকাংশই ভেঙে গেছে। সরকারিভাবে মেরামত করলে অনেক ভালো হয়। বাউন্ডারি দেয়াল দিলে আরও ভালো হয়, সরকার যদি সঠিকভাবে দেখভাল করে তাহলে এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি একটি পর্যটক কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে। যেখান থেকে সরকার অনেক রাজস্ব পেতে পারে। এখানে বিভিন্ন পর্যটকরা এসে দেখতে পায় পুরোনো কালী মন্দির, শিব মন্দির, পুরোনো একটি শিবলিঙ্গ স্থাপিত আছে। এখানে প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো মঠ এবং জমিদার বাড়ি আছে যেগুলো মানুষ এখানে আসলে দেখতে পায়।’

রায়েরকাঠি গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী প্রিয়াঙ্কা বলেন, ‘এটা সাড়ে চারশ বছরের পুরোনো জমিদার বাড়ি। বর্তমানে এটি একটি ঐতিহাসিক স্থান। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে লোকজন ঘুরতে আসে ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখতে আসে এবং ছবি তুলে ভিডিও করে। এখানে বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব হয় এবং রথযাত্রা হয় এবং শিব পূজা হয়। এখানে ধর্মীয় অনুষ্ঠান অনেক বড় করে হয় এবং দূর দূরান্ত থেকে মানুষ ঘুরতে আসে।’

স্থানীয় কাঠমিস্ত্রি গোবিন্দ লাল বলেন, ‘রায়েরকাঠি জমিদার বাড়ি সাড়ে চারশো বছরের পুরোনো। বর্তমানে তা আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সবকিছু ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পর্যটক এখানে ঘুরতে আসে। সরকার থেকে যদি এখানে রক্ষণাবেক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় তাহলে এটি একটি পর্যটক কেন্দ্রে তৈরি হতে পারে। এটি পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হলে এলাকায় অনেক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

পিরোজপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ বলেন, ‘রায়েরকাঠি জমিদার বাড়ি প্রায় সাড়ে চারশ বছরের পুরোনো। এটি একটি দর্শনীয় ও ঐতিহ্যবাহী স্থান। এখানে দেশ বিদেশ থেকে অনেক পর্যটক আসেন। এটি সংস্কারের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে জানানো হবে এবং স্থানীয় পর্যায়ে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।’

বাড়িটি বছরের পর বছর ধরে পড়ে রয়েছে অবহেলিত অবস্থায়, তবু ইতিহাসপ্রেমী পর্যটকদের আগ্রহ কমেনি। সঠিক উদ্যোগ নিলে রায়েরকাঠি জমিদার বাড়ি হয়ে উঠতে পারে গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্র।


দৈএনকে/জে .আ
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন