শুক্রবার, ০১ অগাস্ট ২০২৫
Natun Kagoj
শিরোনাম
  • গুলশানে চাঁদা দাবির ঘটনায় আরও এক ছাত্রনেতা গ্রেফতার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত আদালত গঠন ২০২৬ বিশ্বকাপে ব্রাজিল সমর্থকদের জন্য বড় ধাক্কা আসতে পারে শাহবাগে জুলাই সনদ দাবিতে দ্বিতীয় দিনের অবস্থান কর্মসূচি, যান চলাচল বন্ধ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঐতিহাসিক চুক্তি কূটনৈতিক বিজয়: প্রধান উপদেষ্টা রাজধানীতে ‘গোপন বৈঠক’: নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের ২২ জন গ্রেপ্তার পরিবেশ রক্ষায় প্রশাসনের কড়া বার্তা সংসদের উচ্চকক্ষ ১০০ আসনের, সদস্য মনোনয়ন হবে আনুপাতিক হারে পলিথিন ও শব্দ দূষণ রোধে জরিমানা, জব্দ ও সংযোগ বিচ্ছিন্ন গোপালগঞ্জে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার হয়নি: সেনাসদর
  • বাংলাদেশি সন্দেহে ধরপাকড়, আতঙ্কে স্থানান্তর মুসলিমদের

    বাংলাদেশি সন্দেহে ধরপাকড়, আতঙ্কে স্থানান্তর মুসলিমদের
    ছবি: সংগৃহিত
    গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

    ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গত কয়েক মাস ধরে ‘অবৈধ বাংলাদেশি নাগরিক’ চিহ্নিত করার নামে অভিযান চালানো হচ্ছে। এই অভিযানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সন্দেহভাজন হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষাভাষী নাগরিকদেরও আটক করা হচ্ছে।

    আটকদের মধ্যে অনেকেই প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হলেও, তাদের পরিচয় যাচাই না করেই বাংলাদেশি হিসেবে ধরে নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব রাজ্য থেকে আটক ব্যক্তিদের পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ পুলিশকে অনুরোধ জানানো হচ্ছে।

    তবে আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো—কিছু ক্ষেত্রে প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, সংশ্লিষ্টদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে বলে জানা গেছে।

    এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকারকর্মীরা। তাদের মতে, পরিচয় যাচাই ছাড়াই এ ধরনের পদক্ষেপে নিরপরাধ মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে এবং সীমান্ত পরিস্থিতিও জটিল হয়ে উঠছে।

    কেউ সাতদিন আটক থাকার পর ছাড়া পেয়েও ভয়ে ঘর থেকে বেরুতে পারছেন না। যদি আবারও পুলিশ ধরে নিয়ে যায় এই আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াচ্ছে। অন্য কেউ আবার ট্রেনের টিকিট কবে পাবেন, সেই আশায় আছেন। যেদিন টিকিট পাবেন, সেদিনই চলে যাবেন।

    অনেকে আবার ট্রেনের টিকিটের অপেক্ষা না করে নিজেরাই বাস ভাড়া করে পাড়ি দিয়েছেন দেশের বাড়ি- পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলার দিকে। মোটামুটিভাবে জনপ্রতি আড়াই হাজার টাকা ভাড়া গুনতে হচ্ছে তাদের। কারও চিন্তা হচ্ছে যে কাজকর্ম ছেড়ে দেশের বাড়িতে ফিরে গেলে সেখানে রেখে আসা ছোট সন্তান আর বয়স্ক বাবা-মাকে কী খাওয়াবেন?

    এরা সবাই কর্মসূত্রে দিল্লি লাগোয়া গুরুগ্রামে থাকেন। পশ্চিমবঙ্গের এই বাসিন্দারা সম্প্রতি সেখানকার পুলিশের হাতে আটক হয়েছিলেন ‌‌‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে।

    স্থানীয় শ্রমিক সংগঠন মুকুল শেখ বলেন, পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষ এখান থেকে চলে গেছে। যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে সবাই ভয় পাচ্ছে যে পুলিশ যদি আবার বাংলাদেশি সন্দেহে আটক করে তাহলে কী হবে?

    মালদা জেলার চাঁচোলের বাসিন্দা আনিসুর রহমান স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে গুরুগ্রামে থাকেন প্রায় আট বছর ধরে। নিজে গাড়ি ধোয়ার কাজ করেন, আর তার স্ত্রী গৃহকর্মী। ছেলেও কাজে লেগে পড়েছে। কয়েক সপ্তাহ আগে গুরুগ্রামের আরও অনেক বাংলাভাষীর মতোই তাকেও পুলিশ আটক করেছিল পরিচয় যাচাইয়ের জন্য।

    তিনি বলেন, আমাদের চাঁচোল থানা থেকে আমার পরিচয় যাচাই করিয়ে আনার পরে আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। সাত দিন আটকে রেখেছিল সেক্টর ১০এ-তে একটা কমিউনিটি সেন্টারে।

    আনিসুর রহমান বলেন, আমার আধার কার্ডসহ সব পরিচয়পত্র দেখিয়েছিলাম, কিন্তু কিছুই মানেনি পুলিশ। সাতদিন পরে আমাকে ছেড়েছে। কিন্তু এই যে আটকে রাখল, তারপর ছেড়ে দিল, কোনো কাগজপত্র কিছু দেয়নি। কোনো প্রমাণ নেই যে আমার পরিচয় ভেরিফাই করে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ।

    তিনি বলেন, এই অবস্থায় কোনো কাগজ ছাড়া আমি বাইরে বের হতেও ভয় পাচ্ছি। যদি আবারও ধরে নিয়ে যায়। তিনি জানান, ঘরে ফেরার পর থেকে তিনি আর একবারও বাইরে বের হননি।

    আনিসুর রহমান আরও বলেন, আমি আবার কয়েকদিন পর পুলিশের কাছে যাব। দেখি যদি কোনো লিখিত কিছু দেয়। আর যদি না দেয়, ২ আগস্টের ট্রেনের টিকিট কেটে রেখেছি, সেদিনই বাড়ি ফিরে যাব। পশ্চিমবঙ্গে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন তিনি ঠিকই, তবে বাড়ি ফিরে এসে কীভাবে সংসার চলবে, সেটাই এখন তারা বড় চিন্তা।

    তিনি বলেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী-ছেলে মিলে মাসে ৭০ হাজার টাকার মতো রোজগার করতাম। এদিকে আবার বেশ কিছু ধারও রয়েছে। এখন বাড়ি ফিরে কীভাবে সংসার চালাব জানি না। কিন্তু এখানে আর নয়। তার সঙ্গে আটক হয়েছিলেন, এরকম চারজন এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে এসেছেন।

    মালদারই বাসিন্দা মুকুল হোসেন গুরুগ্রামে এসেছেন মাত্র বছর খানেক হলো। তিনি রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। তিনিও আনিসুর রহমানের সঙ্গেই আটক হয়েছিলেন গুরুগ্রাম পুলিশের হাতে। বুধবার দিবাগত রাতে দিল্লি থেকে ট্রেনে চেপেছেন মালদা জেলায় তার বাড়ি ফিরে আসার জন্য।

    তিনি বলেন, আমি মাত্র এক বছর হলো এখানে কাজে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে এসেই তো ফেঁসে গেলাম। পূর্বপুরুষরা সবাই এদেশের বাসিন্দা, সব পরিচয়পত্র থাকার পরও আটক হয়ে থাকলাম। এখন তো মনে ভয় ধরে গেছে। আর এদিকে আসব না।

    তবে অনেক মানুষ ট্রেনের টিকিট না পেয়ে নিজেরাই বাস ভাড়া করে চলে আসছেন পশ্চিমবঙ্গে। গুরুগ্রামের নানা এলাকা থেকে রোজই এরকম দুই বা তিনটা করে বাস ছাড়ছে।

    সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুপান্থ সিনহা দুই সপ্তাহের মধ্যে দুবার গিয়েছিলেন গুরুগ্রামের বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে। তিনি বলেন, প্রথমে যখন এদের আটক করে রেখেছিল, তখন একবার গিয়েছিলাম, আবার কয়েকদিন আগেও গিয়েছিলাম। সংখ্যাটা বলা কঠিন, কিন্তু অনেক ঘর দেখেছি ফাঁকা পড়ে আছে। মানুষজন আতঙ্কিত হয়ে গুরুগ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। খোলাখুলি কথা বলতেও ভয় পাচ্ছে এরা।

    শ্রমিক সংগঠক মুকুল শেখ বলেন, তার এলাকায় যত মানুষ পশ্চিমবঙ্গে ফিরে গেছেন, তারা প্রায় সবাই মুসলমান, কিন্তু হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মোটামুটি থেকেই গেছেন এখনো।

    একটি ফুড ডেলিভারি অ্যাপের ডেলিভারি বয় হিসেবে কাজ করতেন নূর আলম। অন্যের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেওয়া আলমের এখন দুশ্চিন্তা যে তার নিজের পরিবারকে কী খাওয়াবেন। তিনি বলেন, দেশের বাড়িতে মা-বাবা আছে, ছোট সন্তানটাও তাদের কাছেই থাকে। এখানে আমি আর আমার স্ত্রী থাকতাম। এখানে যা পরিস্থিতি, তাতে দেশে তো ফিরে যেতেই হবে। কিন্তু গিয়ে সংসারের মানুষকে কী খাওয়াব?

    তিনি পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার বাসিন্দা। গুরুগ্রাম পুলিশ তাকে বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করে ছয়দিন আটকে রেখেছিল একটি কমিউনিটি হলে। মালদার পুলিশ তার পরিচয়পত্র যাচাই করে গুরুগ্রাম পুলিশকে চিঠি পাঠানোর পর তাকে ছাড়া হয়েছে।

    তিনি বলেন, অনেক বাংলাভাষীই চলে গেছেন। আমার চেনাশোনা ১০টা পরিবার এখনো রয়েছে। আমরা ট্রেনের টিকিট পাচ্ছি না। যেদিনের টিকিট পাব, সেদিনই চলে যাব।

    গ্রামে তার শুধু বসতভিটাই আছে, কোনো চাষের জমি নেই। তাই কোনো ব্যবসা করা যায় কি না, সেটাই ভাবছেন আলম। নিজের গ্রামে ফিরে এসে কীভাবে সংসার চালাবেন এই চিন্তা থেকেই অনেকে আবার ফিরেও যাচ্ছেন পুরোনো জায়গায়।

    পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক আসিফ ফারুক বলেন, বিভিন্ন রাজ্যে যাদের আটক করা হয়েছিল, তাদের অনেকে যে ফিরে আসছেন, এটা সত্য। তবে আবার এটাও ঘটনা অন্য রাজ্যের পুলিশের হাতে আটক হওয়া, এমনকি বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল যাদের, তাদেরই অন্যতম মেহবুব শেখ-এর মতো অনেকে নিজেদের কাজের জায়গায় ফিরেও যাচ্ছেন। যেমন ছত্তিসগড়, মহারাষ্ট্র, ওড়িষ্যার অনেকেই ফিরে যাচ্ছেন অথবা ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন বলে জানতে পেরেছি।

    তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ঘোষণা করেছেন, যেসব পরিযায়ী শ্রমিক নানা রাজ্য থেকে ফিরে আসছেন, তাদের উপার্জনের জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করে ফেলেছে তার সরকার।
     


    গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

    সর্বশেষ

    আরও পড়ুন