মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫
Natun Kagoj
স্বপ্ন নয়, ধোঁকাই বিক্রি করছে ‘পুষ্পধারা’:

বুকিং মানির ফাঁদে ২ হাজার কোটি টাকার প্রতারণা

বুকিং মানির ফাঁদে ২ হাজার কোটি টাকার প্রতারণা
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

‘স্বপ্ন সত্যি হবেই’ – এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে গত এক দশক ধরে শত শত সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে আসছে কথিত রিয়েল এস্টেট কোম্পানি ‘পুষ্পধারা প্রপার্টিজ লিমিটেড’। জমির মালিক না হয়েও, আইনগত অনুমোদন না নিয়েই প্রতিষ্ঠানটি হাজারো প্লট, ফ্ল্যাট, ডুপ্লেক্স এবং ট্রিপ্লেক্সের বুকিং নিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে একটি ভয়াবহ প্রতারণা চক্রের চিত্র, যেখানে সরকারি কর্মকর্তারাও সুবিধাভোগী। তাদের প্রতারনা নিয়ে আমাদের ধারাবাহিক অনুসন্ধানের প্রথম পর্ব।

জমি নেই, তবু প্লট বিক্রি

২০১৪ সালে যাত্রা শুরু করে পুষ্পধারা। মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর এলাকায় মাত্র ৭০ শতাংশ জমি নিয়ে ‘পদ্মা ভ্যালি’ নামে একটি প্রকল্প ঘোষণা করে তারা। অথচ তাদের বিক্রির বিজ্ঞাপন এবং বুকিং নেওয়া প্লটের সংখ্যা ৩ হাজারেরও বেশি। গুগল ম্যাপ, লে-আউট এবং চটকদার গ্রাফিক্স ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে লক্ষ লক্ষ টাকার বুকিং মানি নেয়া হয়েছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, জমির মালিকানা নেই এমন কৃষিজমি, জলাভূমি, এমনকি খাস জমিকেও নিজের প্রকল্পের অংশ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। জমির পাশে শোভা পাচ্ছে “পুষ্পধারা” সাইনবোর্ড, যা ভাড়ায় স্থাপন করা।

বুকিং বাণিজ্য এবং নীতির নামে ফাঁদ

প্রতিষ্ঠানটির ‘প্লট বরাদ্দ নীতিমালা’ আসলে প্রতারণার প্যাকেজ। কোম্পানির নামে টাকা নেয়া হলেও জমির মালিকানা থাকে পরিচালকদের বা অন্য ব্যক্তির নামে। ফলে আইনি প্রতিকার চাইতে গেলে গ্রাহক পড়ে যান জটিলতার মুখে। যদি গ্রাহক কিস্তি চালাতে ব্যর্থ হন বা বুকিং বাতিল করেন, টাকা ফেরতের কোনো পরিষ্কার নিয়ম নেই। কেবল বুকিং মানি কেটে রেখে ৪ কিস্তিতে ফেরতের কথা বলা হলেও সময়সীমা নির্দিষ্ট নয়।

নিবন্ধন নেই, অনুমোদন নেই

‘পুষ্পধারা’ বা তাদের প্রকল্প ‘পদ্মা ইকো সিটি’ ও ‘পদ্মা ভ্যালি’ – কোনোটিই জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ (জাগৃক), রাজউক, বা পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে কোনো অনুমোদন পায়নি। তবুও ব্রোশিওরে ভুল তথ্য দিয়ে গ্রাহকদের বিভ্রান্ত করছে তারা। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত কোম্পানির তালিকায় তাদের নাম নেই। এমনকি ২০২০ সালের রাজউকের তালিকাতেও ‘পুষ্পধারা’র কোনো অস্তিত্ব নেই।

ক্ষমতাধরদের ছত্রছায়ায় প্রতারণা

প্রতারণাকে বৈধতা দিতে এবং বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে ব্যবহার করা হচ্ছে অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ, এবং ব্যাংকারদের। কেউ মাসোহারা পান, কেউ কমিশন। তাদের ছবিসহ প্রচার চালিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে আস্থা তৈরি করা হয়। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনের এক কনস্টেবলকেও ‘দুদক অফিসার’ পরিচয়ে প্লট বিক্রিতে ব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

জমি দখল ও ভীতিকর বাহিনী

প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে জোরপূর্বক জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। জমির পাশে সাইনবোর্ড লাগালেই শুরু হয় হুমকি। স্থানীয়দের অভিযোগ, পুষ্পধারার একটি নিজস্ব ‘লাঠিয়াল বাহিনী’ রয়েছে যারা জমি থেকে মালিকদের উৎখাত করতে সহিংসতাও করছে। জমির আসল মালিকরা মামলা করতে গেলে পুষ্পধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতায় উল্টো হেনস্থার শিকার হন।

‘কানুন’ অকার্যকর, দুর্নীতির ফাঁদে প্রশাসন

মুন্সিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বলেন, আমাদের কাছে এমন কোনো লিখিত অভিযোগ আসেনি। যেন অভিযোগ না আসলে প্রতারণা হয় না। অন্যদিকে, স্থানীয় এসি ল্যান্ডরা স্বীকার করছেন, জমির নামজারি নেই, পেপারস নেই, তবুও প্রকল্প চলছে। পরিবেশ অধিদপ্তরও স্বীকার করেছে জনবল কম থাকায় তারা যথাযথ মনিটরিং করতে পারছে না।

অভিযান আসবে, তবু প্রশ্ন: কবে?

জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা ঢাকার আশপাশের অবৈধ রিয়েল এস্টেট কোম্পানির বিরুদ্ধে শিগগিরই বিশেষ ড্রাইভ চালাবে। তবে অতীতের অভিজ্ঞতায় প্রশ্ন থেকে যায় এই অভিযান হবে ন্যায়ের পক্ষে, না প্রভাবশালীদের ‘ম্যানেজ’ করেই ঝুলে যাবে?

স্বপ্ন নয়, সচেতনতা জরুরি

‘পুষ্পধারা’ একটি প্রতিষ্ঠান নয়, এটি প্রতারণার প্রতিচ্ছবি। যারা স্বপ্ন কিনতে গিয়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন, তারা আজ বিচারহীনতার শিকার। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও জানতে হবে, খোঁজ না নিয়ে, যাচাই না করে একটি সাইনবোর্ড আর ব্রোশিওর দেখেই কখনোই বিশ্বাস করা উচিত নয়।

এসব বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আলীনূর ইসলাম কোনো মন্তব্য করেননি। তবে খাইরুল ইসলাম নামে তাদের এক পরিচালক এ প্রতিবেদককে ফোন করে এই রিপোর্টটি প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান।


গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

সর্বশেষ