শনিবার, ০৯ অগাস্ট ২০২৫
Natun Kagoj

নাসার বড় ঘোষণা: চাঁদে বসছে পারমাণবিক চুল্লি

নাসার বড় ঘোষণা: চাঁদে বসছে পারমাণবিক চুল্লি
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদের পৃষ্ঠে একটি পারমাণবিক চুল্লি স্থাপনের পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। সম্প্রতি একাধিক মার্কিন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।

নাসার এই উচ্চাভিলাষী প্রকল্পটি মূলত চাঁদে মানুষের স্থায়ী বসবাস নিশ্চিত করার দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টার অংশ। মহাকাশে দীর্ঘ সময় ধরে টেকসই শক্তি সরবরাহের জন্য পারমাণবিক শক্তিকে একটি নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে বিবেচনা করছে সংস্থাটি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পারমাণবিক চুল্লি চাঁদের পৃষ্ঠে বৈদ্যুতিক শক্তি জোগান দেওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও চন্দ্রবসতির জন্য স্থিতিশীল পরিবেশ গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।

পলিটিকোর এক প্রতিবেদনের জানানো হয়েছে, নাসার ভারপ্রাপ্ত প্রধান চীন ও রাশিয়ার একই ধরনের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘ওই দুই দেশ সম্ভবত চাঁদে একটি কিপ-আউট জোন ঘোষণা করতে পারে।’

কিন্তু নাসার সাম্প্রতিক ও তীব্র বাজেট হ্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে লক্ষ্য ও সময়সীমা কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে এবং কিছু বিজ্ঞানী উদ্বিগ্ন যে পরিকল্পনাগুলো ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত।

যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ভারত, জাপানসহ দেশগুলো চাঁদের পৃষ্ঠ অন্বেষণের জন্য তাড়াহুড়া করছে। কিছু দেশ স্থায়ী মানব বসতি স্থাপনের পরিকল্পনাও করছে।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক আস্থাভাজন হিসেবে নাসার সাময়িক প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হওয়া মার্কিন পরিবহন সচিব শন ডাফি নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘ভবিষ্যতের চন্দ্র অর্থনীতি, মঙ্গল গ্রহে উচ্চ শক্তি উৎপাদন এবং মহাকাশে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য এ গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিতে সংস্থাটির দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য।’

তিনি বাণিজ্যিক কম্পানিগুলোকে কমপক্ষে ১০০ কিলোওয়াট শক্তি উৎপাদনে সক্ষম চুল্লি বানানোর প্রস্তাব জমা দেওয়ার আহ্বান জানান।


এটি তুলনামূলকভাবে ছোট আকৃতির। একটি সাধারণ অফশোর উইন্ড টারবাইন ২-৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।
চাঁদে শক্তির উৎস হিসেবে পারমাণবিক চুল্লি তৈরি করার ধারণা নতুন নয়। ২০২২ সালে নাসা কম্পানিগুলোকে ডিজাইনের জন্য তিনটি ৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি প্রদান করেছিল।


চলতি বছরের মে মাসে, চীন ও রাশিয়া ঘোষণা করেছিল, তারা ২০৩৫ সালের মধ্যে চাঁদে একটি স্বয়ংক্রিয় পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র গড়ার পরিকল্পনা করছে।
অনেকে বিজ্ঞানীর মতে, এটি চন্দ্র পৃষ্ঠে নিরবচ্ছিন্ন শক্তি সরবরাহের শ্রেষ্ঠ বা একমাত্র উপায় হতে পারে। একটি চন্দ্র দিন পৃথিবীতে চার সপ্তাহের সমান, যার মধ্যে দুই সপ্তাহ অবিরাম রৌদ্র ও দুই সপ্তাহ অন্ধকার থাকে। এটি সৌরশক্তির ওপর নির্ভরশীলতাকে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং করে তোলে।

বিশ্ববিদ্যালয় অব সারের মহাকাশ প্রযুক্তি, অনুসন্ধান ও যন্ত্রপাতি বিভাগের সিনিয়র লেকচারার ড. সঙ্গউ লিম বলেন, ‘চাঁদে একটি ছোট আবাসস্থল তৈরি করতেও মেগাওয়াট-স্তরের শক্তি প্রয়োজন।


শুধু সৌর প্যানেল ও ব্যাটারিতে তা নির্ভরযোগ্যভাবে পূরণ করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে পারমাণবিক শক্তি কেবল কাম্য নয়, অপরিহার্য।’
ল্যাংকাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃথিবী ও গ্রহীয় বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক লিওনেল উইলসন মনে করেন, পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ হলে ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে চুল্লি স্থাপন করা প্রযুক্তিগতভাবে সম্ভব এবং ইতোমধ্যে ছোট চুল্লির জন্য ডিজাইনও রয়েছে।

কিন্তু এ বিষয়ে নিরাপত্তাসংক্রান্ত কিছু প্রশ্নও রয়েছে। ওপেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ ড. সিমিপন বারবের বলেন, ‘পরমাণু পদার্থ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মাধ্যমে উৎক্ষেপণে নিরাপত্তা উদ্বেগ রয়েছে। এর জন্য বিশেষ অনুমোদন প্রয়োজন হয়, তবে এটি অতিক্রমযোগ্য।’

২০২৬ সালে ট্রাম্প প্রশাসন নাসার বাজেটে ২৪ শতাংশ হ্রাসের ঘোষণা দেওয়ায় নাসায় সাম্প্রতিক অস্থিরতার পর ডাফির এ নির্দেশ অবাক করার মতো। এর মধ্যে গ্রহের পৃষ্ঠ থেকে পৃথিবীতে নমুনা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে মার্স স্যাম্পল রিটার্নের মতো উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিজ্ঞান কর্মসূচিতে কাটছাঁট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

বিজ্ঞানীরা এই ঘোষণা ভূ‑রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দ্বারা অনুপ্রাণিত কি না, সে বিষয়ে উদ্বিগ্ন। বারবের বলেন, ‘এটি যেন পুরনো মহাকাশ প্রতিযোগিতার দিনের মতো ফিরে আসছে, যা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে কিছুটা হতাশাজনক ও উদ্বেগজনক। প্রতিযোগিতা উদ্ভাবন এনে দিতে পারে, কিন্তু যদি জাতীয় স্বার্থে সীমাবদ্ধ হয়ে যায় এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, তাহলে বৈশ্বিক পরিভ্রমণ ও সৌরজগৎ অন্বেষণের বৃহত্তর চিত্র থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়া হতে পারে।’

চাঁদে চীন ও রাশিয়ার একটি ‘কিপ-আউট জোন ঘোষণা’ করার সম্ভাবনা সম্পর্কে ডাফির মন্তব্য আর্টেমিস চুক্তি নামক একটি চুক্তির দিকে ইঙ্গিত করে বলে মনে হচ্ছে। ২০২০ সালে সাতটি দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত এ চুক্তি নির্ধারণ করে, কিভাবে দেশগুলো চাঁদে সম্মিলিতভাবে কাজ করবে।

এ চুক্তি অনুযায়ী ‘সেফটি জোন’ স্থাপনের ধারা রয়েছে, যেখানে দেশগুলো তাদের সম্পদ ও কার্যক্রমের চারপাশে একধরনের নিরাপত্তা এলাকা নির্ধারণ করতে পারে।

বারবের ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘আপনি যদি চাঁদে পারমাণবিক চুল্লি বা কোনো ধরনের ভিত্তি তৈরি করেন, তাহলে আপনি তার আশপাশে একটি সেফটি জোন দাবি করতে পারেন—কারণ সেখানে আপনার যন্ত্রপাতি থাকবে।’

বারবের উল্লেখ করেছেন, মানুষের ব্যবহারের জন্য চাঁদে পারমাণবিক চুল্লি স্থাপনের আগে অনেক বাধা অতিক্রম করতে হবে।

নাসার আর্টেমিস ৩-এর লক্ষ্য ২০২৭ সালে চাঁদের পৃষ্ঠে মানুষ পাঠানো, কিন্তু তহবিল নিয়ে এটি একাধিক বাধা ও অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়েছে।

বারবের আরো বলেন, ‘আপনার কাছে শক্তি থাকল, কিন্তু মানুষ ও সরঞ্জাম সেখানে নিয়ে যাওয়া যাবে না, তাহলে তাতে লাভ কী? বর্তমানে পরিকল্পনাগুলো খুব সংহত মনে হচ্ছে না।’


গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন