৩৭ বছর পর ইংলিশ চ্যানেল জয় হিমেলের


কিশোরগঞ্জের হাওর অধ্যুষিত উপজেলা নিকলীর ছেলে নাজমুল হক হিমেল। সম্প্রতি আটলান্টিক মহাসাগরের ইংলিশ চ্যানেলে দীর্ঘ ৩৩.৪ কিলোমিটার পানিপথ পাড়ি দিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। ৩৭ বছর পর বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছেন সম্মান ও মযার্দা। তার জয়ের এমন মাইলফলক স্পর্শে গর্বিত পরিবার ও এলাকাবাসী।
সারা বিশ্বের মধ্যে ইংলিশ চ্যানেল সাঁতারুদের জন্য আলাদা একটি রোমাঞ্চ। ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার জন্য স্লট পাওয়া দুষ্কর। জেলিফিস, ঠান্ডা পানি ও প্রাকৃতিক বৈরিতার পাশাপাশি ব্যয়ও অনেক। বাংলাদেশির মধ্যে ব্রজেন দাস ও মোশাররফ হোসেন খান ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছিলেন। এবার ৩৭ বছর পর তাদের পথ ধরেই সেই কাজটি করে দেখিয়েছেন কিশোরগঞ্জ নিকলী হাওর উপজেলার ছেলে নাজমুল হক হিমেল। ৩৩.৪ কিলোমিটার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে তার সময় লেগেছে ১২ ঘন্টা ১০ মিনিট। আর এভাবেই হিমেলের হাত ধরে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে দূরন্ত এক ইতিহাস রচিত হলো। তার এমন জয়ে উচ্ছ্বসিত পরিবার।
১৯৯৭ সালে বাবা আবুল হাসেমের মাধ্যমে সাঁতারে হাতেখড়ি হিমেলের। তিনি ছিলেন ‘৮০-এর দশকের জাতীয় সাঁতারু। জাতীয় সুইমিং ফেডারেশনের সাবেক সদস্য ও কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী সুইমিং ক্লাবের কোচ। তিনি বলেন, ‘‘হিমেলের আত্মবিশ্বাস ছিল এবং সে সেটি করে দেখিয়েছে। তবে তার জন্য হিমেলকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। ইংলিশ চ্যানেল আটলান্টিক মহাসাগরে আর সেখানকার তাপমাত্রা ১৫ থেকে ১৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস। যেহেতু হাওরের তাপমাত্রা অনেক বেশি তাই হিমেল ড্রামের ভেতর বরফ দিয়ে সর্বনিম্ন ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ঘন্টার পর ঘন্টা ছিল। আর নিজেকে প্রস্তুত করেছে।’’
কিশোরগঞ্জ-নিকলী সাঁতার দলের প্রশিক্ষক জুবায়ের বলেন, ‘‘হিমেল ভাই আমাদের তথা এই দেশের গর্ব। তাকে দেখেই নতুন প্রজন্ম সাঁতারু হতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। আমরা ছোট বেলায় বাড়ির পেছনে হাওরের সুয়াইনজান নদীতে সাঁতার কেটে বড় হয়েছি। নিকলী সুইমিং ক্লাব থেকে আমরাও ছোট-বড় প্রায় দুইশত ছেলে-মেয়েকে সাঁতার প্রশিক্ষণ করাচ্ছি। এদের থেকেও অনেকে জাতীয় পর্যায়ে অনেক পুরস্কার অর্জন করেছে। ভবিষ্যতে এদের থেকে আরও হিমেল তৈরি হবে এবং বিশ্ব জয় করবে তেমনটাই প্রত্যাশা করছি।’’
হিমেলের বড় ভাই এনামুল হক রুবেল বলেন, ‘‘১৯৮৯ সালে কিশোরগঞ্জের নিকলীর মীরহাটি গ্রামে জন্ম হিমেলের। চার ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয় হিমেল। মধ্যবিত্ত পরিবারে আমাদের বড় হয়ে উঠা। অনেক সংগ্রাম করে আমাদের পথচলা। হিমেলের এমন অর্জনে আমরা আবেগাপ্লুত।’’
হিমেলের বন্ধুমহল ও এলাকাবাসীরা বলেন, ‘‘নিকলী হাওরে জন্মগ্রহণ করে ছোট ছোট অর্জন গুলো আজ হিমেলের জন্য বড় অর্জন বয়ে এনেছে। এতে অনেক খুশি ও গর্বিত তার বন্ধুমহল। তবে আমাদের দাবি এতো এতো সাতারু নিকলী থেকে দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনলেও এখানে কোন সুইমিং পুল নেই। আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি এটি, তাই প্রশাসন ও কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে নজর দেয়ার অনুরোধ করছি।’’
লন্ডন থেকে মুঠোফোনে দৈনিক নতুন কাগজকে নাজমুল হক হিমেল জানান, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাঁতার শুরু করেন সাঁতারু মো. সোলায়মানের কাছে। তারপর জাপানি কোচ ও সবশেষ চীনা কোচের অধীনে দক্ষতা বৃদ্ধি করেছেন সাঁতারু হিসেবে। ১৯৯৮ থেকে ২০০৮ সালে সাঁতারের বিভিন্ন ইভেন্টে তার ঝুঁলিতে এসেছে ২৬টি স্বর্ণ ও ২১টি রৌপ্য পদক। বয়সভিত্তিক সাঁতারেও গড়েছেন ছয়টি জাতীয় রেকর্ড।তিনি আরও বলেন, ‘‘ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়া স্বপ্ন ছিল। তবে যখন সেটি জয় করতে পেরেছি। আমি এ আনন্দ বা অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।’’
নিকলী উপজেলার নির্বাহী অফিসার রেহানা মজুমদার মুক্তি জানান, নিকলীতে কোন সুইমিং পুল নেই। উপজেলা পরিষদের পুকুরেই এখানকার ছেলেরা সাঁতার শিখছে। হিমেলের বিজয় বিশ্বের বুকে লাল-সবুজের পতাকার সম্মান ও হাওর এলাকার সুনাম বাড়িয়েছে। আর তার পথ ধরেই হাওরের আরও খ্যাতিমান সাঁতারু তৈরি হবে, এমনটাই প্রত্যাশা আমাদের।
