৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান; একটি ফ্যাসিস্ট শাসনের পতন ও নতুন স্বপ্নের ভিত্তিপ্রস্তর


২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় রচিত হয়েছিল, যে অধ্যায়ের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে শুরু হওয়া এই আন্দোলন অচিরেই রূপ নেয় সর্বস্তরের মানুষের গণআন্দোলনে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, পেশাজীবী, নারী, সংখ্যালঘু, ধর্মনিরপেক্ষ ও ভিন্নমতাবলম্বী, সবাই এক কণ্ঠে বলেছিলেন: বৈষম্যের অবসান চাই।
এই আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল এর বৈচিত্র্যময় অংশগ্রহণ এবং নেতৃত্বের বিকেন্দ্রীকরণ। এখানে নেতৃত্ব মানে ছিল না শুধু বক্তৃতা, বরং মাঠে থাকা, লাঠিচার্জের মুখে দাঁড়িয়ে যাওয়া, সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠা। পোস্টারে, মিছিলে, প্রতিবাদী গান ও কবিতায় যে ভাষা উচ্চারিত হয়েছে, তা ছিল এই প্রজন্মের নতুন আত্মপরিচয়ের ভাষা।
তৎকালীন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকার এই আন্দোলনকে দমন করতে টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, গুম, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের আশ্রয় নেয়। কিন্তু এসব দমননীতির ফল হয় উল্টো। জনগণ একত্রিত হয়, আন্দোলন পায় জনসমর্থন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের মাধ্যমে এই দমন-পীড়নভিত্তিক, ভারত অনুগত শাসনের অবসান ঘটে।
এই দিনটি তাই শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক বিজয় নয়, বরং জাতীয় জাগরণের প্রতীক। এটি ছিল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্মক্ষণ, এক ফ্যাসিস্ট শাসকের পতনের দিন।
এক বছর পর ফিরে তাকালে স্পষ্ট হয়, আমাদের সামনে এখনো বহু চ্যালেঞ্জ। আন্দোলনের সময় যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার বিচার আজও হয়নি। নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছেন শহীদ পরিবারের সদস্য ও আন্দোলনকারীরা। পুরোনো কাঠামো এখনো অনেকখানি অটুট রয়ে গেছে। গোপালগঞ্জে পুনরায় ক্যাডার সংগঠনের অভিযোগ উঠছে; ভারত থেকে আসছে রাজনৈতিক হুমকি। এসব আমাদের মনে করিয়ে দেয়, স্বপ্নের বাস্তবায়ন সহজ নয়।
তবু প্রাপ্তির খাতা খালি নয়। আজ আমরা নিশ্বাস নিতে পারছি এমন বাস্তবতা একসময় কল্পনারও বাইরে ছিল। পুলিশের গুলি বা রাতে তুলে নেওয়ার আতঙ্ক ছাড়াই আজ কর্মসূচি পালন সম্ভব। বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা কমেছে, গুমের ঘটনা অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। যদিও পথ অনেক বাকি, কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এই গণঅভ্যুত্থান প্রজন্মকে বদলে দিয়েছে। একসময় যারা রাজনীতিকে ঘৃণা করত, তারা আজ রাজনীতিকে প্রশ্ন করে, পাল্টে দিতে চায়। যারা নিঃশব্দ ছিল, তারা আজ শব্দ তুলে শাসকের মুখোমুখি দাঁড়ায়। এই মানসিক জাগরণই ৫ আগস্টের সবচেয়ে বড় অর্জন।
বিগত এক বছরে যারা থেমে গেছেন, হতাশ হয়েছেন, তাদের বুঝতে হবে আন্দোলন মানে শুধু বিজয় নয়; এটি সময়ের সাথে নিজেকে প্রস্তুত করার প্রক্রিয়া। আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক মুঈনুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার অবসান ও নতুন এক বন্দোবস্ত গঠনের জন্য সময় লাগে, নিষ্ঠা লাগে।
আমরা এখনো সেই যাত্রায় আছি। সামনে বহু পথ, কিন্তু পেছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই। নতুন প্রজন্মের আত্মবিশ্বাস, একতা ও ত্যাগের ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে একটি সাম্যভিত্তিক, গণতান্ত্রিক এবং মানবিক বাংলাদেশ।
এই দিনটি শুধু ইতিহাসের স্মারক নয়, এটি ভবিষ্যতের দিশারিও বটে।
৫ আগস্ট হোক আমাদের জাতীয় চেতনার প্রতীক, যে চেতনাই একদিন ফ্যাসিস্ট শাসনের কবল থেকে জাতিকে মুক্ত করেছিল। এখন প্রয়োজন, সেই চেতনার ধারক-বাহকদের রক্ষা, বিচার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা।
