রবিবার, ২৭ জুলাই ২০২৫
Natun Kagoj

ঢাকার সড়কে ফিটনেসবিহীন ‘গোলাপি’ বাস; জৌলুস নেই- ঝুঁকি আছে

ঢাকার সড়কে ফিটনেসবিহীন ‘গোলাপি’ বাস; জৌলুস নেই- ঝুঁকি আছে
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

রাজধানীর সড়কে ‘গোলাপি’ বাসগুলো এখন লক্কড়-ঝক্কর, ফিটনেস সনদহীন এবং প্রযুক্তিগতভাবে অরক্ষিত। যাত্রীরা বলছেন, “এ ধরনের বাস অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত।” প্রশাসনের নাকের ডগায় প্রতিদিনই চলছে এসব যান, আর দুর্ঘটনা এড়াতে চালক ও বাসের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা-কিংবা জবাবদিহি-প্রায় নেই বললেই চলে।

ঢাকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে বহুবার পরিকল্পনা, রোডম্যাপ ও অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু শহরের বিভিন্ন রুটে এখনো এমন বহু ‘গোলাপি’ রঙের পুরনো বাস চলাচল করছে, যেগুলোর বেশিরভাগেরই ফিটনেস সনদ, ব্রেক ও সাসপেনশনের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং নির্ধারিত সময়ের সার্ভিসিংয়ের নথি নেই-এমন অভিযোগ যাত্রী ও সংশ্লিষ্টদের।

রাস্তার বাস্তবতাঃ সকালে অফিসগামীদের ভিড়ের সময় মহাখালী, বাড্ডা, মালিবাগ, ফার্মগেট, বিজয় সরণি ও গাবতলী-মতিঝিল রুটে চোখে পড়ে এই বাসগুলোর পরিত্যক্ত জৌলুস। অনেক বাসের হেডলাইট কাজ করে না, উইন্ডশিল্ড ফাটা, দরজার অটো-ক্লোজিং ব্যবস্থা অকার্যকর, ইন্ডিকেটর লাইট বারবার নষ্ট হয়ে যায়। শব্দদূষণকারী এক্সস্ট পাইপ থেকে কালো ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে।

সুমি আক্তার, বেসরকারি চাকরিজীবী (মালিবাগ থেকে ফার্মগেট রুট)- “বাসে উঠতেই দেখি জানালার কাচ নড়বড়ে, সিটের স্ক্রু খুলে গেছে। চালক হঠাৎ ব্রেক করলে আমি প্রায় পড়ে যাই। এই বাসগুলো চললে আমাদের জীবনটাই ঝুঁকিতে পড়ে।”

রফিকুল ইসলাম, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী (গাবতলী থেকে শাহবাগ রুট)- “ফিটনেস আছে কি নেই-যাত্রী হিসেবে আমরা তো দেখি বাসটা রাস্তায় চলছেই। কালকে দেখি ব্রেক চেপেও বাসটা থামতে সময় নিচ্ছে। আমি ভাবলাম, যদি সামনে কোনো মোটরসাইকেল বা পথচারী থাকত!”

হাবিবুল্লাহ (ছদ্মনাম), ১২ বছর ধরে বাস চালান- “গাড়িটার বয়স ২০ বছরের কাছাকাছি। মালিক বলছে, ‘চলো, আয় করো; পরে দেখব।’ ফিটনেস করলে গাড়ি কয়েকদিন বন্ধ রাখতে হবে, খরচও বেশি-এটা মালিকরা করতে চায় না। আমরাও চাপের মুখে গাড়ি বের করি।”

তিনি আরও বলেন, “ব্রেক-শু বা সাসপেনশনে সমস্যা হলে মৌসুমী মেরামত করি, কিন্তু নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের একটা কাঠামো নেই।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান- “আমরা নিয়মিত চেক করি, কাগজপত্র না থাকলে মামলা দিই। কিন্তু মামলা দিয়েই তো বাস রাস্তা থেকে নামানো যায় না। প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয় ছাড়া এই বাসগুলো পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়। প্রত্যেক রুটে ‘এক রুট এক কোম্পানি’ বাস্তবায়ন হলে, জবাবদিহি তৈরি হবে-তখন এ ধরনের ফিটনেসবিহীন বাস রাস্তায় নামবে না।”

প্রশাসনের নাকের ডগায় কেন চলছে?

মনিটরিং দুর্বলতা: ফিটনেস ও রেজিস্ট্রেশন যাচাইয়ের জন্য ডিজিটাল ব্যবস্থা থাকলেও মাঠপর্যায়ের সমন্বয় ও রাজনৈতিক/অর্থনৈতিক চাপের কারণে কার্যকারিতা কম।

অর্থনৈতিক প্রণোদনার অভাব: পুরনো বাস স্ক্র্যাপ করতে মালিকদের জন্য আর্থিক সহায়তা বা বিনিয়োগ-উদ্দীপনা নেই।

বিক্ষিপ্ত মালিকানা কাঠামো: একই রুটে ডজনখানেক মালিক ও অসংগঠিত অপারেটর—ফলে দায়িত্ব কার, তা নির্ধারণ কঠিন।

এবিষয়ে আইন কী বলে (সংক্ষেপে)- 

ফিটনেস সনদ বাধ্যতামূলক: প্রতি নির্ধারিত মেয়াদে যান্ত্রিক সক্ষমতা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে যানবাহন রাস্তায় চলতে পারে না। ধোঁয়াজনিত দূষণ, ব্রেক/লাইট অকেজো—ট্রাফিক আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। চালকের বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স ও নির্ধারিত ডিউটি-ঘণ্টার সীমা মেনে চলা বাধ্যতামূলক।


ঝুঁকির পরিণতি: 

ব্রেক ফেল/স্টিয়ারিং লক হয়ে বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা

ডোর সিস্টেম অকেজো থাকলে চলন্ত বাস থেকে যাত্রীর পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি

এক্সস্টের কালো ধোঁয়া থেকে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, শিশু ও বয়স্কদের স্বাস্থ্যঝুঁকি

ওভারলোডিং—চ্যাসিস ও সাসপেনশনে বাড়তি চাপ, ব্রেকিং দূরত্ব আরও দীর্ঘ

সমাধানের পথ কি?

জরুরি জোন-ভিত্তিক ফিটনেস অভিযান: রুটভিত্তিক তালিকা করে ফিটনেসহীন বাস শনাক্ত ও সাময়িকভাবে রাস্তাচ্যুত করা। ‘অন-দ্য-স্পট’ টেকনিক্যাল চেকপোস্ট: ব্রেক, লাইট, ইন্ডিকেটর, টায়ারের গ্রিপ—তাৎক্ষণিক পরীক্ষার ব্যবস্থা। ড্রাইভারদের বাধ্যতামূলক রিফ্রেশার কোর্স: বিশেষ করে পুরনো বাস চালকদের জন্য। এক রুট এক কোম্পানি বাস্তবায়ন: আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা, রক্ষণাবেক্ষণ ফান্ড বাধ্যতামূলক। স্ক্র্যাপেজ নীতি চালু: নির্দিষ্ট বয়সোত্তীর্ণ বাসের বদলে নতুন বাসে বিনিয়োগে করছাড়/প্রণোদনা। ডিজিটাল ফিটনেস ট্র্যাকিং: প্রতিটি বাসে কিউআর কোড/আরএফআইডি—সড়কে চেকপোস্টে স্ক্যান করেই অবস্থা জানা যাবে। একীভূত গণপরিবহন কর্তৃপক্ষের অধীনে অপারেশন: মালিকদের শেয়ারভিত্তিক অংশীদারিত্ব, পেশাদার ম্যানেজমেন্ট। নিরাপত্তা মানদণ্ড আপডেট: ইউরো-স্ট্যান্ডার্ড নির্ভর এমিশন নর্ম, এডিএএস (ADAS) বা বেসিক সেফটি টেকনোলজি ধাপে ধাপে বাধ্যতামূলক করা।

যাত্রীদের জন্য করণীয়: বাসে ওঠার আগে সামনের লাইট, দরজা, টায়ার ও ধোঁয়া খেয়াল করা—অস্বাভাবিক হলে পরবর্তী বাস নিন, হঠাৎ ব্রেকের আশঙ্কায় দাঁড়িয়ে থাকলে হ্যান্ডরেল ধরে থাকুন, অসুরক্ষিত বাসের নম্বর, রুট ও সময় লিখে অভিযোগ জানান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা অ্যাপে, চালকের সাথে অপ্রয়োজনীয় বিতণ্ডায় না জড়িয়ে নিরাপদ বিকল্প বেছে নিন।


এন কে/বিএইচ
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন