নৌকার গায়ে হাতুড়ির শব্দে জেগে ওঠে সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা


বর্ষা এলেই নতুন জীবন পায় সাতক্ষীরার ঐতিহ্যবাহী নৌকা শিল্প। পাটকেলঘাটা অঞ্চলে নৌকার গায়ে হাতুড়ির টুংটাং শব্দ যেন জানান দেয়—জলাবদ্ধতায় ভেসে ওঠা জনজীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জেগে উঠেছে এক পুরনো কৃষ্টির পুনর্জাগরণ।
জেলার বেশিরভাগ এলাকা বর্ষাকালে জলমগ্ন হয়ে পড়ে। গ্রাম থেকে গ্রাম, বিল থেকে মাঠ—সব জায়গায় তখন একমাত্র ভরসা হয় নৌকা। মাছের ঘেরে কাজ, খালে মাছ ধরা, কিংবা জলপথে চলাচল—সবকিছুতেই তখন নৌকার প্রয়োজন। ফলে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার পাটকেলঘাটায় জমে ওঠে কাঠের নৌকা তৈরির ছোট-বড় বহু কারখানা।
জেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে পাটকেলঘাটা গেলে দেখা মেলে এমন ছয়টি কারখানার, যেখানে সকাল হতেই শুরু হয় কাঠের গায়ে করাতের ঘর্ষণ আর হাতুড়ির তাল। আলকাতরার গন্ধে যেন আচ্ছন্ন হয়ে থাকে পুরো এলাকা। একেকটা কারখানা যেন একেকটা শিল্পভিত্তিক কর্মশালা, যেখানে তৈরি হচ্ছে জীবনযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ বাহন—নৌকা।
৬৫ বছর বয়সী কারিগর মারজান গাজী বলেন, “৫০ বছর ধরে নৌকা বানাচ্ছি। নদী শুকিয়ে গেলেও চাহিদা শুকায়নি। বরং এ বছর একটু বেশি বর্ষা হওয়ায় আগের তুলনায় বেশি নৌকা বানাতে হচ্ছে।
এখানে তৈরি হয় ট্রলার, পালতোলা, কোশা ও ডিঙ্গিসহ নানা ধরনের নৌকা। মেহগনি, খৈ ও চম্বল কাঠ দিয়ে তৈরি এসব নৌকা কেনেন সাতক্ষীরা, খুলনা, এমনকি দেশের অন্যান্য জেলার ব্যবসায়ীরা। একেকটি মাঝারি আকৃতির নৌকা বানাতে লাগে দুজন কারিগরের দুদিন সময়। দাম পড়ে ১৫ থেকে ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।
নৌকা কিনতে আসা কলারোয়ার মাছচাষি মহিব বিল্লাহ বলেন, আগাম বৃষ্টিতে এলাকা জলে ডুবে গেছে। মাছের ঘেরে ঢুকতে হলে নৌকা দরকার। তাই বাধ্য হয়ে কিনতে এলাম।
তবে এই শিল্পে লাভের হিসাব খুব সুখকর নয়। ‘মেসার্স ঐশী’ নৌকা কারখানার মালিক শেখ আনোয়ার হোসেন জানান, “লাভ যা হয়, সেটা নিতান্তই ভালোবাসা থেকে। কাঠ, পেরেক, পিচ—সবকিছুর দাম বেড়েছে। শ্রমিকদের বেতন ও জায়গার ভাড়া মেটাতে গিয়ে হাতে তেমন কিছু থাকে না।
এমনই অভিজ্ঞতার কথা শোনান ‘সুমি ফার্নিচার অ্যান্ড নৌকা কারখানা’র মালিক জাকির হোসেন এবং ‘তৈয়েবা নৌকা কারখানা’র মালিক আক্তারুজ্জামান বিশ্বাস। তাঁদের ভাষায়, “নৌকা আমাদের পেশা না, আমাদের পরিচয়।
পাটকেলঘাটা বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল লতিফ সরদার বলেন, এই শিল্পের ওপর নির্ভর করে স্থানীয় অনেক পরিবার। সরকার একটু সহযোগিতা করলে তরুণ উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসতে পারবে।
শৈশব স্মৃতিচারণ করে সাতক্ষীরার বিশিষ্ট কবি ও লেখক পল্টু বাশার বলেন, “সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ, ক্ষুদ্রঋণ কিংবা অনুদানের সুযোগ থাকলে আমরা তা পৌঁছে দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প টিকিয়ে রাখাতে হবে। নৌকা আমাদের প্রাচীন বাহনের একটি। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদী বাঁচাতে হবে এবং আদি বাহন নৌকার ঐতিহ্য ধরে রাখতে হবে।
জেলা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক শেখ আজাদ হোসেন বেলাল বলেন, "নৌকা আমাদের যাতায়াতের প্রাচীন বাহনের একটি। নদী বিলুপ্ত হওয়ার সাথে সাথে প্রাচীন এই বাহনটিও বিলুপ্তির পথে। প্রতি বছর বর্ষাকাল এলেই জেলাজুড়ে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। তখন নৌকাই হয়ে ওঠে জলাবদ্ধ গ্রামের মানুষের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম।
তিনি আরও বলেন, প্রকৃতি আর প্রয়োজনের টানে বারবার ফিরে আসে নৌকার প্রয়োজন। আর সেই প্রয়োজন মেটাতে জীবনের অভিজ্ঞতা আর ভালোবাসা দিয়ে পাটকেলঘাটার কারিগরেরা গড়ে তোলেন কাঠের শরীরে ভেসে চলা একেকটি জীবন্ত স্বপ্ন। প্রয়োজন শুধু একটু সহায়তা, আর এই শিল্পটি হয়ে উঠতে পারে সাতক্ষীরার অর্থনীতির শক্ত একটি স্তম্ভ।
