প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ এসোসিয়েশনের নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ


বাংলাদেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ সমূহের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ এসোসিয়েশন (বিপিএমসিএ)। ২০১০ সালে জয়েন্ট স্টক কোম্পানীতে নিবন্ধিত এই প্রতিষ্ঠান। ২০১০ সালে জয়েন্ট স্টক কোম্পানীতে নিবন্ধিত এই প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯৪ সালের কোম্পানী আইনের ২৮ ধারার অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। দেশের ৬৭ টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে ৫৫ টি প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ বিপিএমসিএ-র বর্তমান সদস্য। ১৯৬১ সালের বাণিজ্য সংগঠন অধ্যাদেশ ও ১৯৯৪ সালের বাণিজ্যিক সংগঠন বিধিমালা অনুসারে ২১ সদস্যবিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হয় সংগঠনটি। তবে সংগঠনটির আসন্ন কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচন (২০২৫-২০২৭ মেয়াদ) নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। নির্দিষ্ট প্যানেলকে সুবিধা দিতে সংগঠনের গঠনতন্ত্র পরিপন্থি নানা সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন প্রার্থীরা।
বিপিএমসিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০২৫ সালের ২৫ মার্চ অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ এসোসিয়েশন (বিপিএমসিএ)'র ১১৫ তম সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক এবং বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা, ১৯৯৪ এর বিধি-১৪(১) এবং এসোসিয়েশনের সংঘ স্মারক ও সংঘ বিধির ২৭ নং অনুচ্ছেদের অধীনে ২ বছর (২০২৫-২০২৭) মেয়াদের জন্য ৩ (তিন) সদস্য বিশিষ্ট (১ জন চেয়ারম্যান ও ২ জন সদস্য) নির্বাচন বোর্ড গঠন করা হয়। গ্রীন লাইফ মেডিকেল কলেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. মো. মঈনুল আহসানকে নির্বাচন বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং আদ্-দ্বীন উইমেন্স মেডিকেল কলেজের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মো. আফিকুর রহমান ও খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজের পরিচালক ডা. মোস্তফা কামালকে সদস্য করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১৯ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে বিপিএমসিএ-র নির্বাহী কমিটির ২০২৫-২০২৭ মেয়াদে নির্বাচনের ভোটার হওয়ার জন্য কলেজের ব্যবস্থপনা কর্তৃপক্ষের ২ (দুই) জন প্রতিনিধির নাম ও বকেয়া চাঁদা ১৪ মে ২০২৫ এর মধ্যে পরিশোধের জন্য নির্বাচন বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং অন্য দুই সদস্য স্বাক্ষরিত নোটিশ প্রদান করা হয়। এছাড়া একই তারিখে চেয়ারম্যানসহ অন্য দুই সদস্য স্বাক্ষরিত স্মারকে নির্বাচন সংক্রান্ত নোটিশ (২০২৫-২০২৭) এবং বিপিএমসিএ-র কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচন তফসিল (২০২৫-২০২৭ মেয়াদ) ঘোষণা করা হয়।
পরবর্তীতে একই স্মারক ও তারিখের স্থলাভিশিক্ত শিরোনামে নির্বাচন সংক্রান্ত নোটিশ (২০২৫-২০২৭) ও নির্বাচন পুনঃ তফসিল-এর ঘোষনাতেও নির্বাচন বোর্ডের তিন জনের স্বাক্ষর রয়েছে। গত ০৭ মে ২০২৫ এ প্রকাশিত বিপিএমসিএ কার্যকরী পরিষদ নির্বাচন (২০২৫-২০২৭) এর নির্বাচনী নিয়মাবলী এবং ২৮ মে ২০২৫ এ প্রকাশিত ভাট প্রদানের নিয়মাবলী সংক্রান্ত নোটিশে নির্বাচন বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ অপর দুই সদস্যের স্বাক্ষর রয়েছে। এছাড়াও ২২ মে ২০২৫ এ প্রকাশিত প্রাথমিক ভোটার তালিকা এবং ২৯ মে প্রকাশিত চুড়ান্ত ভোটার তালিকাতেও রয়েছে নির্বাচন বোর্ডের তিন জনের স্বাক্ষর।
অভিযোগ রয়েছে, নির্বাচন বোর্ডের ঘোষিত পুনঃ তফসিল অনুযায়ী ১৫ জুন ২০২৫ এ মনোনয়ন পত্র যাচাই বাছাই ও বৈধভাবে মনোনীত প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশের কথা থাকলেও খসড়া প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে শুধুমাত্র নির্বাচন বোর্ডের চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর রয়েছে। অন্য দুজন সদস্যের নাম থাকলেও তারা সেখানে স্বাক্ষর করেন নি। বিপিএমসিএ-র সংঘ বিধির ২৭ ধারা মোতাবেক নির্বাচন বোর্ড তিন সদস্য বিশিষ্ট। সুতরাং অন্য দুজন সদস্য ব্যতীত চেয়ারম্যান এককভাবে নির্বাচন বোর্ডকে প্রতিনিধত্ব করেন না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন একাধিক প্রার্থী।
এছাড়া পুনঃ তফসিল অনুযায়ী ১৮ জুন বৈধ মনোনীত প্রার্থীর চ‚ড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, সেখানেও শুধুমাত্র চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর রয়েছে। একইসাথে প্রকাশিত খসড়া প্রার্থী তালিকা এবং বৈধ মনোনীত প্রার্থীর তালিকার মাঝেও বেশ পার্থক্য রয়েছে।
- খসড়া প্রার্থী তালিকা অনুযায়ী সাংগঠনিক সম্পাদক (বিভাগওয়ারী-চট্রগ্রাম বিভাগ) পদে প্রার্থী ১ জন। অথচ বৈধ মনোনীত প্রার্থীর তালিকায় রইস আবদুর রবের নাম যুক্ত করে প্রার্থী ২ জন করা হয়েছে।
- যুগ্ম সম্পাদক চারটি পদে খসড়া প্রার্থী তালিকায় ৭ জন প্রার্থী। অথচ বৈধ মনোনীত প্রার্থীর তালিকায় রয়েছে ৮ জন। নতুন করে নিজামউদ্দিন হাসান রশিদের নাম যুক্ত করা হয়েছে।
- সাংগঠনিক সম্পাদক (বিভাগওয়ারী- রাজশাহী বিভাগ) পদে প্রার্থী খসড়া প্রার্থী তালিকায় ১ জন প্রার্থী থাকলেও বৈধ মনোনীত প্রার্থীর তালিকা গাজী সেজান তানভীরের নাম যুক্ত করে ২ জন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও অনিয়ম করা হয়েছে গাজী সেজান তানভীন খুলনার গাজী মেডিকেল কলেজের পরিচালক অথচ তিনি রাজশাহী বিভাগের প্রার্থী।
- খসড়া প্রার্থী তালিকায় নির্বাহী সদস্যের তিন পদে ৫ জন প্রার্থী হলেও বৈধ মনোনীত প্রার্থীর তালিকাতে সে সংখ্যা ৬ জন উল্লেখ রয়েছে। নতুন করে ড. শাহ্ মো. সেলিমের নাম যুক্ত করা হয়েছে।
নির্বাচনে নানা অসংগতির কারণে নির্বাচন বোর্ডের সভাপতির সাথে একমত না হওয়া এবং সভাপতির একক কর্তৃত্ব শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হবে কিনা তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করছেন কয়েকজন প্রার্থী।
যুগ্ম সম্পাদক পদের এক প্রার্থী বলেন, নির্বাচন বোর্ডের অন্য দুইজন সদস্যকে বাদ দিয়ে নির্বাচনের বৈধ প্রার্থী তালিকার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চেয়ারম্যান একক ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্বাচনের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। নির্বাচন বোর্ডের তিন সদস্য স্বাক্ষরিত বৈধ প্রার্থী তালিকা পুনরায় প্রকাশের দাবি জানাচ্ছি।
এদিকে নির্বাচন বোর্ড মারফত বিপিএমসিএ সচিব গত ২০ জুন ২০২৫ তারিখে প্রথম আলো পত্রিকায় নির্বাচন সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। অথচ বিপিএমসিএ বা নির্বাচন বোর্ডে এমন কোন পদ নেই বলে জানা গেছে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ জুন ২০২৫ তারিখে নির্বাচন বোর্ড মনোনয়নপত্র যাচাই বাছাইয়ের সময় ইতিপূর্বে ঘোষিত নির্বাচনী নিয়মাবলীর ৫ নং ধারা অনুযায়ী (জমা দেওয়া মনোনয়ন পত্রে প্রার্থী/প্রস্তাবক/সমর্থনকারীর নামের বানান ভুল, ওভার রাইটিং করা, ইরেজার দিয়ে কোন লেখা মোছার চেষ্টা করা, লেখার কোন কাটাকাটি করলে বা কোন ভুল তথ্য প্রদান করলে মনোনয়ন পত্র বাতিল বলে গন্য হবে) বেশ কিছু মনোনয়ন পত্র বাতিল হয়ে যায়। নির্বাচনী নিয়মাবলীর ধারা অনুযায়ি নির্বাচন বোর্ডের ২ সদস্য তাদের সিদ্ধান্তে অনঢ় থাকতে চান, কিন্তু নির্বাচন বোর্ডের চেয়ারম্যান তাতে সম্মতি দেননি। ১৫ জুন প্রকাশিত খসড়া প্রার্থী তালিকায় নির্বাচন বোর্ডের অন্য সদস্যরা স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানালে শুধুমাত্র সভাপতি স্বাক্ষর করেন। পরবর্তীতে শুধুমাত্র সভাপতির স্বাক্ষরে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, যার সাথে অন্য দুজন সদস্য একমত নন। যেহেতু সংঘ বিধির ২৭ ধারা অনুযায়ী তিন জন মিলেই নির্বাচন বোর্ড, তাই শুধুমাত্র চেয়ারম্যানের সম্মতিকে নির্বাচন বোর্ডের সিদ্ধান্ত বলা যায় না উল্লেখ করেছেন নির্বাচন বোর্ডের অন্য দুই সদস্য।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ২১ জুন ২০২৫ তারিখে নির্বাচন বোর্ড কার্যালয়-র স্মারক বিপিএমসিএ/২০২৫/১০/৪৯৮ এ শুধুমাত্র নির্বাচন বোর্ডের সভাপতি স্বাক্ষরিত বৈধ মনোনীত প্রার্থীর ২টি চুড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। তবে প্রকাশিত সেই দুইটি তালিকায় একটির সাথে অন্যটির পার্থক্য রয়েছে। একটি তালিকায় আইন বিষয়ক সম্পাদক পদে ডা. মাহফুজা জেসমিনের নাম এবং শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক পদে ডা. মো. এমদাদুল হকের নাম। অপর তালিকায় শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও সমাজ কল্যাণ সম্মাদক পদে ডা. মাহফুজা জেসমিন এবং আইন বিষয়ক সম্পাদক পদে ডা. মো. এমদাদুল হক।
বিভিন্ন অনিয়ম সত্ত্বেও আগামী ১৬ জুলাই ২০২৫ তারিখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের তফসিল রয়েছে। তবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হবে কিনা তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করছেন প্রার্থীরা। একটি নির্দিষ্ট প্যানেলকে সুবিধা দিতে সংগঠনের গঠনতন্ত্র পরিপন্থি এবং নির্বাচন বোর্ডের দুই সদস্যকে উপক্ষো করে সভাপতি নানা বিষয়ে একক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এবিষয়ে বিপিএমসিএ’র নির্বাহী কমিটির নির্বাচন (২০২৫-২০২৭) এর নির্বাচন বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক ডা. মো. আফিকুর রহমান বলেন, নির্বাচন বোর্ডের সদস্য হিসেবে আমরা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কয়েকটি মিটিং সুন্দর ভাবে সম্পন্ন হয়েছে। তবে মনোনয়নপত্র যাচাই বাছাইয়ের সময় কয়েকজন প্রার্থীর নামের বানান ভুল, ওভার রাইটিং করাসহ বিভিন্ন অসংগতি ধরা পড়ে। নির্বাচন বোর্ডের তিনজনের সম্মতিক্রমে চারজন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করা হয় এবং সুষ্ঠ নির্বাচনের স্বার্থে আমরা একমত পোষণ করি। পরবর্তীতে বাতিলকৃত প্রার্থীর নাম দিয়ে বৈধ এবং চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা করায় আমরা দুইজন সদস্য স্বাক্ষর করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করি। সভাপতি নিজের দায়িত্বে এককভাবে স্বাক্ষর করে বৈধ এবং চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে, যার সাথে আমরা একমত নয়। বাকি কর্মকান্ডের সাথে আমরা জড়িত নয়।
নির্বাচন বোর্ডের সভাপতি ডা. মো. মঈনুল আহসান বলেন, আমরা নিয়মের বাইরে কিছু করি নাই। নিয়মের বাইরে একচুল যায় নাই। সব কিছু নিয়মের মধ্যে থেকে হয়েছে। এসময় তিনি ব্যস্ততার কথা বলে বিপিএমসিএ’র অফিসে যোগাযোগ করতে বলেন।
