শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫
Natun Kagoj

সুনাম ছড়ানো হাঁড়িভাঙা আমের পেছনের ইতিহাস

সুনাম ছড়ানো হাঁড়িভাঙা আমের পেছনের ইতিহাস
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

বাংলাদেশের আমপ্রেমীদের হৃদয়ে গভীরভাবে গেঁথে আছে ‘হাঁড়িভাঙা’। রংপুরের মিঠাপুকুরে যার জন্ম, সেই আম আজ দেশের সীমানা পেরিয়ে পৌঁছে গেছে বিদেশের বাজারেও। আঁশবিহীন গঠন, অতুলনীয় মিষ্টি স্বাদ আর ছোট আঁটির জন্য এ আম শুধু একটি ফল নয়; হয়ে উঠেছে উত্তরবঙ্গের অহংকার। তবে এমন অসাধারণ এক আমের নাম ‘হাঁড়িভাঙা’—সেটি শুনেই অনেকে কৌতূহলী হয়ে পড়েন, এই নাম কেন? কোথা থেকে এলো?

ফলের রাজা হিসেবে পরিচিত আমের আছে নানা জাত ও স্বাদের বৈচিত্র্য। তবে এ বৈচিত্র্যের ভিড়ে যে জাতটি আলাদা জায়গা করে নিয়েছে, তা হলো ‘হাঁড়িভাঙা’। সুস্বাদু আমটি পরিণত হয়েছে রংপুরের ‘ব্র্যান্ডে’। হাঁড়িভাঙা আমের যাত্রা শুরু হয়েছিল রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তেকানী গ্রাম থেকে। তবে ‘হাঁড়িভাঙা’ নামকরণের পেছনের গল্পটিও ঠিক ততটাই মজার; যতটা সুস্বাদু এ আম।

জানা গেছে, হাঁড়িভাঙা আমটির গোড়াপত্তন করেছেন নফল উদ্দিন পাইকার। তিনি একজন বৃক্ষপ্রেমী ছিলেন। সম্ভবত ১৯৪৯ সালের দিকে রংপুরের মিঠাপুকুরের বালুয়া মাসুমপুর গ্রামটি ছিল ঝোঁপজঙ্গলে ভরপুর। সেই এলাকার একটি জমি থেকে দুটি আমের চারা নিয়ে এসে কলম করেন নফল উদ্দিন। তখন আমটির নাম ছিল মালদিয়া।

দুর্ভাগ্যবশত একটি গাছ চুরি হয়ে যায়। বাকি আম গাছটিতে মাটির হাঁড়ি বেঁধে ফিল্টার বানিয়ে পানি দেওয়া হতো। একদিন রাতে কে বা কারা মাটির সেই হাঁড়িটি ভেঙে ফেলে। তবে গাছটিতে একসময় বিপুল পরিমাণ আম ধরে। যা দেখতেও সুন্দর, খেতেও খুবই সুস্বাদু। এরপর বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে গেলে কৌতূহলী ক্রেতারা ওই আম সম্পর্কে জানতে চান।

তখন নফল উদ্দিন মজা করে বলেছিলেন, ‘যেই গাছে লাগানো হাঁড়িটি মানুষ ভেঙে ফেলেছে; সেই হাঁড়িভাঙা গাছের আম এগুলো।’ তখন থেকেই গাছটির আম ‘হাঁড়িভাঙা’ নামে পরিচিতি পায়। একটি হাস্যকর ঘটনা ও আমের অনন্য স্বাদ—দুয়ে মিলে শুরু হয় এক নতুন ইতিহাস।

সুস্বাদু ও মিষ্টি হওয়ায় চারদিকে আমটির খবর ছড়িয়ে পড়ে। পরে সেই মাতৃগাছ থেকে জোড়কলম করার হিড়িক পড়ে যায়। এলাকার মানুষ জোড়া কলম নিয়ে লাগাতে থাকেন। গড়ে উঠতে থাকে বাগান। নফল উদ্দিন মারা যাওয়ার পর হাঁড়িভাঙা আমের মাতৃগাছে মানুষ এসে এত জোড়কলম করতে লাগলেন যে, গাছটির ডালগুলো হেলে পড়া শুরু করল। এরপর আশির দশকে বাণিজ্যিকভাবে গাছের কলম করে অনেকেই আমবাগান গড়ে তুলতে শুরু করেন।

হাঁড়িভাঙা আমের সম্প্রসারণে অনেকই যুক্ত আছেন। তবে এরমধ্যে লুৎফর রহমান ও আবদুস সালাম সরকারের আছে আলাদা পরিচিতি। ১৯৯০ সালের পর থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হাঁড়িভাঙা আম চাষ শুরু করেন তারা। বর্তমানে রংপুর জেলার বিস্তৃতি ছেড়ে হাঁড়িভাঙা নীলফামারী সদর, সৈয়দপুর, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, খানসামা, চিরিরবন্দর এলাকায়ও চাষ হচ্ছে হাঁড়িভাঙা।

মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের তেকানী গ্রামে মাতৃগাছটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে নীরবে। তার শাখা-প্রশাখা ছড়ানো, গোঁড়া এমন মোটা যে দুইজন মিলেও পুরোটা জড়িয়ে ধরতে পারবেন না। আজ যতই নতুন নতুন গাছের চাষ হোক; মাতৃগাছটি রয়ে গেছে ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী হয়ে। যা এখনো ফল দিয়ে যাচ্ছে।

এ আমের গাছ আকর্ষণীয়। ডগা পুষ্ট ও বলিষ্ঠ। ডালে জোড়কলম লাগালে গাছ দ্রুত বাড়তে থাকে। চারা রোপণের পরবর্তী বছরেই মুকুলের দেখা মেলে। এ ছাড়া এ আম গাছের ডালপালা ঊর্ধ্বমুখী বা আকাশচুম্বী হওয়ার চেয়ে পাশে বেশি বিস্তৃত হয়। উচ্চতা কম হওয়ায় ঝড়-বাতাসে গাছ উপড়ে পড়ে না এবং আম কম ঝরে।

হাঁড়িভাঙা আম আঁশবিহীন, মিষ্টি ও সুস্বাদু। আমের উপরিভাগ বেশি মোটা ও চওড়া, নিচের অংশ চিকন। দেখতে সুঠাম ও মাংসালো, শ্বাস গোলাকার ও একটু লম্বা। চামড়া পাতলা। এ আমের আঁটিও খুব ছোট। চামড়া কুচকে গেলেও সহজে আম পচে না। ছোট থেকে পাকা পর্যন্ত একেক স্তরে একেক স্বাদ পাওয়া যায়।

প্রতিটি আমের ওজন হয় ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম। প্রতি বছর জুনের দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় সপ্তাহ থেকে আম সংগ্রহ করা হয়। মৌসুমী ফল হিসেবে এই আম ভোক্তাদের আগ্রহের জায়গা দখল করতে পেরেছে।


দৈএনকে/জে .আ
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

সর্বশেষ