শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫
Natun Kagoj

দোয়ারাবাজারে অপরিকল্পিত ফসলরক্ষা বাঁধ এখন কৃষকের গলার কাটা

দোয়ারাবাজারে অপরিকল্পিত ফসলরক্ষা বাঁধ এখন কৃষকের গলার কাটা
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার চিলাই নদীর পূর্বপাড়ে দুই কিলোমিটার ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এলজিইডি’র অধীনে ও হকনগর পানি ব্যবস্থাপনা সমিতির বাস্তবায়নে নির্মিত এই অপরিকল্পিত বাঁধটি এখন কৃষকদের জন্য একটি গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কৃষকদের অভিযোগ, সরকারি টাকা অপচয় করতে নির্ধারিত স্থানে বাঁধ নির্মাণ না করে পূর্বে নির্মিত রাস্তার উপর সামান্য মাটির প্রলেপ দিয়ে দায়সারা কাজ করা হয়েছে। এতে বাঁধটি বোরো ফসল রক্ষায় কৃষকদের কোন কাজে আসবে না বলে জানান স্থানীয়রা। 

এছাড়াও, অপরিকল্পিত এই বাঁধের কারণে আগামী বর্ষা মৌসুমে স্থানীয়দের ঘরবাড়ি জলাবদ্ধ হয়ে যাবে এবং আমন চাষ নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে।  


জানা গেছে, দোয়ারাবাজার উপজেলার চিলাই নদীর পূর্বপাড়ে কৃষকদের বোরো ফসল রক্ষায় বেরিবাঁধ নির্মাণের জন্য সরকার ৯৭ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেয়। উপজেলা এলজিইডি’র অধীনে ও হকনগর পানি ব্যবস্থাপনা সমিতির বাস্তবায়নে প্রকল্পের কাজ শুরুর পর থেকেই অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় কৃষকরা। কৃষকদের বাঁধা-নিষেধ উপেক্ষা করে, যেদিকে বেরিবাঁধ নির্মাণ হলে কৃষকদের উপকার হতো, সেদিকে বাঁধ নির্মাণ না করে প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করতে পূর্বে নির্মিত রাস্তার উপর দিয়ে কাজ শুরু করা হয়েছে।  

উপজেলা এলজিইডি’র যোগসাজশে হকনগর পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির সভাপতি আনোয়ার ভূইয়া ও সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ উরফে বাবুল ডাক্তার মিলে সরকারি প্রকল্পের অর্থ হাতিয়ে নিতে অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছেন বলে অভিযোগ করছেন স্থানীয়রা।

এদিকে, অকেজো এই বাঁধ নির্মাণেও রয়েছে নানা অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগ। হকনগর পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির মাধ্যমে কাজটি বাস্তবায়িত হলেও সমিতির অন্যান্য শতাধিক সদস্য এ বিষয়ে কিছু জানেন না। পারিবারিক মিটিংয়ের মাধ্যমে কাউকে কিছু না জানিয়ে নিরবে চলছে লুঠপাটের কাজ, এমন অভিযোগ করেছেন সমিতির অধিকাংশ সদস্য।

এছাড়াও, জোরপূর্বক স্থানীয়দের ফসলি জমির টপ সয়েল ও বাঁধের গোড়া থেকে এক্সকাভেটর দিয়ে পুকুরের মত গর্ত করে বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। কেউ বাঁধা-নিষেধ দিলেও, সরকারি কাজে মাটি দিতে হবে বলে স্থানীয়দের বাধ্য করা হচ্ছে। মাটি নেয়ার পর তারা জমি ভরাট করার শর্তে মাটি দিয়েছেন, কিন্তু পরে সংশ্লিষ্টরা লাপাত্তা হয়ে যান। যোগাযোগ করলেও তাদের কিছু করার নেই বলে জমির মালিকদের সাথে রূঢ় আচরণ করা হয়। পরবর্তীতে গর্ত ভরাট করতে ঘন্টাপ্রতি তিন হাজার টাকা দিতে বলা হয়। অসহায় বিধবা মহিলার জমি ভরাট করতেও ঘন্টাপ্রতি তিন হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে। 

এদিকে, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের জন্য স্থানীয় কৃষক এমদাদুল হকের পুকুর পাড়ের ৬০টি গাছ কর্তন করা হয়েছে, যার ফলে প্রায় লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়েছে। এভাবে আরও একাধিক কৃষকের শাক-সবজি বাগানের ক্ষতি করে সেখান থেকে মাটি উত্তোলন করে বাঁধ নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্থানীয়রা জানান, তাঁদের মারাত্মক ক্ষতি হলেও কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। উল্টো, সরকারি কাজ চলার কথা বলে কাজের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে ভয়ভীতি ও হুমকি দেওয়া হয়।

গ্রামের প্রবীণ মুরুব্বি আব্দুল হামিদ জানান, "অপরিকল্পিত এই ফসলরক্ষা বাঁধের কারণে আমাদের বর্ষাকালে সাতার কেটে মরতে হবে। অন্যত্রে যাওয়ার আমাদের সাধ্য নেই। পূর্বের রাস্তার উপর সামান্য মাটি ফেলেই তারা বাঁধ নির্মাণের কাজ করছে। এই বাঁধে আমাদের কোনো লাভ হবে না, বরং সবদিক দিয়ে আমাদের ক্ষতি হবে।" 

শফিক মিয়া নামের এক ব্যক্তি বলেন, "এই বাঁধটির কারণে আমাদের বাড়িঘর হুমকির মুখে, আমরা আতঙ্কে রয়েছি। বাপ-দাদার আমলে নির্মিত রাস্তা দিয়ে বেরিবাঁধটি নির্মাণ করা হয়েছে। সরকারি টাকা হরিলুট করতে কৃষকের স্বার্থের কথা চিন্তা না করে নিজেদের পকেট ভারী করতে বাঁধটি নির্মাণ করা হয়েছে।"

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী বলেন, "হকনগর পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির সভাপতি আনোয়ার ভূইয়া, সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ উরফে বাবুল ডাক্তার ও মোতালিব ভূইয়াসহ কয়েকজন জোরপূর্বক আমাদের জমিকে পুকুরে পরিণত করে বাঁধে মাটি ফেলছে। আমরা প্রথমে মাটি দিতে রাজি না হলেও তারা আমাদের বাধ্য করেছে।"

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ছালিক মিয়া বলেন, "বাঁধ নির্মাণ করতে গিয়ে আমার পুকুরের ৬০টি গাছ কেটে ফেলেছে। এতে প্রায় লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়েছে। অনেকের টমেটো ক্ষেত, শাক-সবজি ক্ষেত নষ্ট করে জমি পুকুর বানিয়ে মাটি আনা হচ্ছে।"

এ বিষয়ে হকনগর পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ উরফে বাবুল ডাক্তার বলেন, "সরকারি প্রকল্পের কাজে সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করেই কৃষকের সুবিধার জন্য আমরা কাজটি করছি। তবে, যে মাটি আমরা আনা হচ্ছে সেটা ভরাট করার কথা বলেই আনা হচ্ছে।" 

এদিকে, দোয়ারাবাজার এলজিইডি’র উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল হামিদ জানান, "আমরা শিডিউল মোতাবেক কাজটি করছি। জোরপূর্বক বা হুমকি দিয়ে কারো জমি থেকে মাটি আনা হয়নি। যদি কোনো অনিয়ম হয়, তবে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"


নতুন/কাগজ/এনামুল/সুনামগঞ্জ
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

সর্বশেষ