শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫
Natun Kagoj
চট্টগ্রামে অপ্রতিরোধ্য অবৈধ ইটভাটা;

উৎকোচ পায় প্রশাসন, সাংবাদিক ও স্থানীয় নেতারা

উৎকোচ পায় প্রশাসন, সাংবাদিক ও স্থানীয় নেতারা
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

অল্প খরচে অধিক মুনাফা, কাঠের সহজলভ্যতা এবং প্রশাসন, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চট্টগ্রামে যত্রতত্র গড়ে উঠছে অবৈধ ইটভাটা। এসব ইটভাটার কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি কৃষিক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। তবে যথাযথ মনিটরিং ও আইনের কার্যকর প্রয়োগের অভাবে এ সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান মিলছে না।


পরিবেশ অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ তথ্যমতে, চট্টগ্রাম জেলায় মোট ইটভাটার সংখ্যা ৪০৮টি। এর মধ্যে ফিক্সড চিমনি (৮০-১২০ ফুট) ২৮৪টি, জিগজ্যাগ চিমনি ১২১টি এবং অন্যান্য ৩টি। ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৩১০টি ইটভাটা অনুমোদনহীন বা মেয়াদোত্তীর্ণ পরিবেশগত ছাড়পত্র নিয়ে চলছে।


ইটভাটাগুলোর মধ্যে রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় ৫৪টি, ফটিকছড়িতে ৫২টি, লোহাগাড়ায় ৩৩টি, রাউজানে ৩৩টি, হাটহাজারীতে ৩১টি, চন্দনাইশে ২৮টি, মিরসরাইয়ে ১৩টি, কর্ণফুলীতে ১০টি, সন্দ্বীপে ৬টি, বাঁশখালীতে ৬টি, সীতাকুণ্ডে ৪টি, বোয়ালখালীতে ৪টি এবং আনোয়ারায় ২টি রয়েছে।


ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, ৫ (১) ধারায় বলা হয়েছে, "কোনও ব্যক্তি কৃষিজমি বা পাহাড় বা টিলা থেকে মাটি কেটে ইট তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন না।"

৬ ধারায় বলা হয়েছে, "ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে কাঠ ব্যবহার করা যাবে না।"


অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ৪০৮টি ইটভাটার মধ্যে ২৭৬টি পাহাড়বেষ্টিত উপজেলা সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, রাঙ্গুনিয়া, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, রাউজান ও চন্দনাইশে অবস্থিত। এসব উপজেলার প্রায় ৮০ শতাংশ ইটভাটা পাহাড়ি মাটি বা টিলা থেকে মাটি সংগ্রহ করছে। পাশাপাশি জ্বালানির জন্য কাঠ ব্যবহারের প্রবণতাও এখনও বিদ্যমান।


চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. অলক পাল জানান, “ইটভাটাগুলোতে নিম্নমানের কয়লা, টায়ার ও গার্মেন্টসের ঝুট কাপড় পোড়ানো হয়, যা মারাত্মক বায়ু দূষণের কারণ। এছাড়া জ্বালানির ছাই আশপাশের কৃষিজমিতে গিয়ে ফসল উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে। ইটভাটাবেষ্টিত এলাকায় কৃষি উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।”


তিনি আরও বলেন, "এসব এলাকার মানুষ স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগছে। বিশেষ করে, শ্বাসকষ্ট ও এলার্জির প্রকোপ বাড়ছে। বিকল্প পদ্ধতিতে পরিবেশবান্ধব ইট উৎপাদন ছাড়া এ সমস্যা থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়।"


২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’ (HRPB) উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করে। ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি হাইকোর্ট পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া গড়ে ওঠা সব অবৈধ ইটভাটা বন্ধের নির্দেশ দেন।


এই নির্দেশনার পর কিছু অভিযান চালানো হলেও, অজ্ঞাত কারণে তা মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা, স্থানীয় সংবাদকর্মী ও রাজনৈতিক নেতাদের মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে অভিযান স্থগিত করা হয়।


গত ২০ জানুয়ারি ডিসি সম্মেলনে আবারও অবৈধ ইটভাটা বন্ধের বিষয়টি আলোচনায় আসে। কিন্তু সম্মেলনের ২০ দিন পেরিয়ে গেলেও দৃশ্যমান কোনও অগ্রগতি নেই।


অবৈধ ইটভাটা বন্ধে প্রশাসনের কার্যক্রম জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক বলেন, "২০২৫ সালের মধ্যে ইটভাটাগুলোকে শতভাগ পরিবেশবান্ধব ‘হলো ব্রিকস’ উৎপাদনে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।"


পরিবেশ অধিদপ্তর-চট্টগ্রামের উপপরিচালক মোজাহিদুর রহমান অভিযানের ব্যর্থতার দায় উপজেলা প্রশাসনের ওপর চাপিয়ে বলেন, "আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি, তবে লোকবল সংকটের কারণে সব জায়গায় নজরদারি করা কঠিন। এই বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনকেও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।"


তিনি আরও বলেন, "ইটভাটার মালিকরা বেশিরভাগই রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকেন। অভিযান চালাতে গেলে নানা তদবির শুরু হয়ে যায়, ফলে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। এছাড়া দুর্গম এলাকায় অভিযান পরিচালনাও কঠিন।"


তবে ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, "আমরা আমাদের সর্বোচ্চ দিয়ে কাজ করছি। জনবল সংকট ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অসহযোগিতার মধ্যেও আমরা দিনভর অফিসের কাজ শেষ করে রাতে অভিযান চালাই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, অফিস থেকে বের হলেই চোরাকারবারিরা খবর পেয়ে সটকে পড়ে। ফলে হাতে-নাতে ধরা সম্ভব হয় না।"


সরেজমিনে অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রায় প্রতিটি এলাকায় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা এই অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। অভিযানের তথ্য আগেভাগে ফাঁস হয়ে যাওয়ার কারণও তাদের সংশ্লিষ্টতা।


স্থানীয় সূত্র বলছে, আগে এই চোরাকারবারি নিয়ন্ত্রণ করতেন আওয়ামী লীগের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি। কিন্তু ‘জুলাই বিপ্লবের’ পর আওয়ামী লীগের নেতারা গা ঢাকা দিলে এখন অন্য দলগুলোর নেতারা সেই জায়গা দখল করেছে। ফলে প্রশাসনের অভিযান চললেও অপরাধীরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।


বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা গেছে, প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সঙ্গে গোপন সমঝোতা করেই ইটভাটাগুলো চালু রাখা হচ্ছে। অভিযানের আপডেট চোরাকারবারিদের জানিয়ে দেয় তাদের পাহারাদাররা। ফলে প্রশাসনের গাড়ি রওনা হওয়ার আগেই অপরাধীরা পালিয়ে যায়, আর রাত পেরোলেই আবারও শুরু হয় অবৈধ কার্যক্রম।


বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি এই অনিয়ম ও অপরাধ চলতে থাকে, তাহলে কয়েক বছরের মধ্যে চট্টগ্রামের বনাঞ্চল প্রায় ধ্বংস হয়ে যাবে। একইসঙ্গে, ফসলি জমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যাবে, যা কৃষি উৎপাদনে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে।

সরকারি উদ্যোগ, আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসন ছাড়া চট্টগ্রামের পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব নয়। অন্যথায়, এই অঞ্চলে আগামী প্রজন্মের জন্য টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।


নতুন/কাগজ/সালেহী/চট্টগ্রাম
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

সর্বশেষ