আরজুর মলিন মুখ, আদনান জানে না বাবা নেই


আড়াই বছরের শিশু আদনানের চোখ শুধু খুঁজে বেড়াচ্ছে বাবাকে। বাড়ির দরজার দিকে তাকি বাবার খোঁজ করছে অবুঝ আদনান। কিন্তু বাবা ফেরে না, দেখাও মিলছে না সারাজীবনের জন্য অদৃশ্য হয়ে যাওয়া বাবা নেজাম উদ্দিনের।
শুক্রবার (৭ মার্চ) রাতে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ডাকাতের গুজব ছড়িয়ে দুই জামায়াত কর্মীকে হত্যার ঘটনায় নিহত নেজাম উদ্দিনের বাসায় গিয়ে তার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। এ সময় আরজুর শিশু সন্তান আদনানের চোখে মুখে ছিল বাবাকে খুঁজে ফেরার ছবি। শিশু আদনানের মা ও নিহত নেজামের স্ত্রী আরজু আকতার বলেন, আমার ছোট বাচ্চাটা বাবা ছাড়া কিছু বোঝে না। বার বার বলছে, বাবার কাছে যাব! আমি কোথায় নিয়ে যাই। আমার স্বামীকে এখন কে ফিরিয়ে দেবে? ওকে বোঝানো যাচ্ছে না বাবা আর ফিরবে না! এটা খুব কষ্টের।
আরজু আকতার আরও বলেন, সবার সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক ছিল নেজামের। সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলত। রাজনীতি করার কারণে অনেক মানুষের সঙ্গে মিশত। জানাজায় মানুষের ঢল নেমেছিল, সবাই নেজামের জন্য কেঁদেছে। তিনি বলেন, ‘এই বাচ্চাকে নিয়ে আমি কী করব, আমার তো সব নিয়ে নিলো। বাচ্চাটা নিয়ে আমি কই যাব? আমার গোছানো সংসার শেষ, তছনছ হয়ে গেলো। আরজু বলেন, ‘আমার টাকা-পয়সার অভাব নাই। সব আছে কিন্তু আমার স্বামী নাই। যারা আমার স্বামীকে মারছে, আমার বাচ্চাটারে এতিম বানাইছে, আমি ওদের ফাঁসি চাই। আমার স্বামীকে মেরে ওরা আমার দুনিয়া অন্ধকার করে দিছে, আমার স্বামী একটা দিনও নিজের ঘর ছাড়া অন্য কোথাও থাকত না। সেই কিনা আর ফিরে এলো না।
নেজামকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে উল্লেখ করে ঘটনার বিবরণ দিয়ে স্ত্রী আরজু আকতার বলেন, ‘এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা গ্রাম বহু বছর ধরে সন্ত্রাস কবলিত এলাকা। সাবেক চেয়ারম্যান মানিক ও তার বাহিনী বারবার এ অঞ্চলে সন্ত্রাসী হামলা, খুন-গুম ও লুটতরাজ চালিয়ে এসেছে। এই সন্ত্রাসী বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষের পাহাড়, ইটভাটা, জমি-জমা দখল করে আসছে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন মামলা ও হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। নেজাম উদ্দিন ও আবু ছালেককে হত্যার পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল তাদের ব্যবসা ও জমি-জমার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। তাদেরকে বিচার করার কথা বলে ডেকে নিয়ে গণপিটুনির নামে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই একই কৌশলে ২০১৬ সালে মানিক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে জামায়াত কর্মী আবুল বশরকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
এদিকে মর্গ সূত্রে জানা গেছে, নেজাম উদ্দিন ও ছালেককে উপুর্যুপরি কোপানো হয়েছে। কোপানোর কারণে নেজামের মগজ বেরিয়ে গেছে। তাদের শরীরে শতাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। বেশিরভাগ আঘাতই মাথা আর ঘাড়ে। নেজামের মুখ বিকৃত হয়ে গেছে। মৃত্যু নিশ্চিত করতে নেজামের পায়ের রগও কেটে দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সুপারের বক্তব্যের প্রতিবাদে বিক্ষোভ:
গত বৃহস্পতিবার (৬ মার্চ) নিজ কার্যালয়ে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু একটি বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন যে, নিহত নেজাম উদ্দিন ও আবু ছালেক সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন এবং তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র উদ্ধারের অভিযোগ করেছেন। একইসাথে তিনি বলেছেন তাদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। জেলা পুলিশ সুপারের এমন বক্তব্যের প্রতিবাদে শুক্রবার বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাদে জুমা সাতকানিয়া উপজেলার কাঞ্চনা কাজীর জামে মসজিদ থেকে শুরু করে জোটপুকুরিয়া হতে ফুলতলা এসে বিক্ষোভ মিছিলটি সমাপ্ত হয়।
এ সময় চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপারের বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বক্তারা বলেন, এই মামলাগুলো পতিত স্বৈরাচার সরকারের আমলে পেটুয়া পুলিশ বাহিনী কর্তৃক দায়েরকৃত মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা। যেখানের অধিকাংশ মামলা মহামান্য আদালত ডিসমিস করেছেন ও করছেন। কিন্তু পুলিশ সুপার স্বপ্রণোদিত হয়ে সন্ত্রাসীদের বাঁচাতে এমন বক্তব্য দেওয়ায় সাধারণ জনতার মাঝে জনরোষ তৈরি হয়েছে। তারা পুলিশ সুপারের এমন কল্পকাহিনীর বক্তব্যকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখান করেছেন।
দাবি জানিয়েছেন, যেহেতু স্বৈরাচারের পেটুয়া পুলিশ কর্মকর্তার ভাষায় তিনি কথা বলেছেন, সেহেতু তাকে অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। পাশাপাশি পুলিশ সুপারে বক্তব্যের ভিত্তিতে কিছু গণমাধ্যমও বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রকাশ করেছে। যা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। নিহত নেজাম উদ্দিন ও আবু ছালেক ছিলেন সাধারণ ব্যবসায়ী এবং এলাকায় সুপরিচিত ব্যক্তি। পুলিশ সুপারের এই বক্তব্য এবং অস্ত্র উদ্ধারের দাবি একটি নাটক মাত্র, যা হত্যাকারীদের রক্ষা ও নিরপরাধ ব্যক্তিদের অপরাধী বানানোর চেষ্টা।
হত্যাকান্ডের বিচার চেয়ে ৬ দাবি:
নেজাম ও ছালেক নিহতের ঘটনাকে পরিকল্পিত হত্যাকান্ড উল্লেখ করে এর বিচার দাবিতে ৬ দাবি উত্থাপন করেছেন প্রতিবাদী জনতা। দাবিগুলো হলো:
১. পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত চিহ্নিত খুনিদের অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে।
২. এই হত্যাকান্ডের গডফাদারদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিতে হবে।
৩. চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতুর বিভ্রান্তিকর বক্তব্য অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
৪. নেজাম ও ছালেকের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে দেওয়া মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
৫. চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপারকে অপসারণ ও বদলি করতে হবে।
৬. সন্ত্রাসীদের মদতদাতা ও হত্যাকান্ডে সংশ্লিষ্ট সকল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
এই হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে প্রধান উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, মানবাধিকার সংস্থাগুলো ও দেশের সচেতন নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। সাতকানিয়ার নিরীহ জনগণকে সন্ত্রাস ও জুলুমের হাত থেকে মুক্ত করতে সরকার, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় সাতকানিয়ার সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করবে বলে প্রতিবাদ সমাবেশে হুঁশিয়ারি দেন বক্তারা।
নতুন/কাগজ/নুরুল/কবির/সাতকানিয়া/চট্রগ্ৰাম
