টেস্টে ভাঙনের মুখে অস্ট্রেলিয়া, সামনে সিদ্ধান্তের চ্যালেঞ্জ


আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) ফাইনাল মানেই যেন অস্ট্রেলিয়ার অবধারিত জয়—দীর্ঘদিন এমনটাই মনে করত ক্রিকেটবিশ্ব। ফাইনালের মঞ্চে অসিদের পা পড়লেই ট্রফি তাদের হাতে ওঠে, এমন এক অভ্যস্ত দৃশ্য ছিল। কিন্তু এবারের লর্ডস টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হেরে সেই চেনা ছবিতে দেখা দিল বড়সড় ফাটল।
১৯৯৬ সালের পর থেকে আইসিসির বিভিন্ন ফরম্যাটে অস্ট্রেলিয়া অংশ নিয়েছে ১০টি ফাইনালে। এর মধ্যে তারা জিতেছে ৯টি, হেরেছে মাত্র একবার—২০১০ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ইংল্যান্ডের কাছে। কিন্তু এবারের হারটি যেন শুধুই একটি পরাজয় নয়, বরং তা এক নতুন অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত।
বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের (ডব্লিউটিসি) ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে পরাজয় অস্ট্রেলিয়ার জন্য দুঃস্বপ্নের মতো। তারা না শুধু শিরোপা হারিয়েছে, বরং দলীয় কাঠামো, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং সিনিয়রদের ভবিষ্যত নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকা বরাবরই টেস্টে ধারাবাহিকতা দেখালেও ফাইনাল জয়ের স্বাদ পায়নি এতদিন। এবার সেই আক্ষেপ ঘুচিয়ে লর্ডসে ইতিহাস গড়েছে প্রোটিয়ারা। কঠিন পরিস্থিতিতে অসিদের চাপে রেখেই ম্যাচ নিজেদের করে নেয় তারা।
অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া দলের ভেতরে শুরু হয়েছে আত্মসমালোচনার পালা। একদিকে সিনিয়র খেলোয়াড়দের বয়স, অন্যদিকে ব্যাটিং অর্ডারের ভঙ্গুরতা—সব মিলিয়ে দলকে নতুনভাবে গুছিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট।
বিশ্ব ক্রিকেটে এই হার শুধু একটি ট্রফির হাতছাড়া হওয়া নয়, বরং এক ‘অজেয়’ অস্ট্রেলিয়ার ভাবমূর্তিতে প্রথমবারের মতো দৃশ্যমান চিড়। বিশ্ব ক্রিকেটের মানচিত্রে এটি এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
ম্যাচ শেষে অধিনায়ক প্যাট কামিন্স বলেন, “লর্ডসের কন্ডিশন ছিল চ্যালেঞ্জিং, কিন্তু এটা তো এক ধরনের ‘ওয়ান-অফ’ ফাইনাল, যেখানে সবাইকে বাড়তি কিছু দিতে হতো। বিশেষ করে আমাদের টপ অর্ডারের পারফরম্যান্স হতাশাজনক ছিল।”
এই হারের পর শুধু ট্রফিই নয়, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়েও অস্বস্তি ঘিরে ধরেছে অস্ট্রেলিয়াকে। পুরোপুরি পুনর্গঠন নয়, তবে কিছু অংশে ‘স্ট্র্যাটেজিক রিফ্রেশ’ আসতে চলেছে—এটাই ইঙ্গিত দিলেন কামিন্স। আগামী ২৫ জুন শুরু হতে যাওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর দিয়েই শুরু হবে নতুন ডব্লিউটিসি চক্র। সে সফরই হতে পারে পরিবর্তনের সূচনা।
অস্ট্রেলিয়ার সম্ভাব্য নতুনদের তালিকায় উঠে আসছে স্যাম কনস্তাস, যিনি ভারতের বিপক্ষে টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা রাখেন। উইকেটকিপার হিসেবে বিকল্প হতে পারেন অভিজ্ঞ জশ ইংলিশ। বোলিং লাইনআপে রোটেশনের অংশ হিসেবে বিবেচনায় আছেন বর্ষীয়ান স্কট বোল্যান্ড (৩৬) ও ব্রেন্ডন ডগেট (৩১)। মূল পেস ত্রয়ীকে মাঝে মাঝে বিশ্রাম দিয়ে ভিন্ন কৌশলে এগোতে পারে টিম ম্যানেজমেন্ট।
কামিন্সের ভাষায়, “সাদা বলের ক্রিকেটে আমরা চার বছরের পরিকল্পনায় দল গড়ি। এবার টেস্ট ফরম্যাটেও হয়তো সে রকম একটি রিসেটের সময় এসেছে।”
তবে পরাজয়ের দায় কার? প্রস্তুতির ঘাটতি, নাকি ব্যাটিং ব্যর্থতা? অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, লর্ডসে নামার আগে কেন কোনও প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেনি অস্ট্রেলিয়া। শুধু অনুশীলন ম্যাচেই সীমাবদ্ধ থেকেছিল দল। যদিও ২০২৩ সালের ফাইনালের আগেও তারা একই পথ অনুসরণ করেছিল, এবং সেবার ফল ছিল চমৎকার।
এই বিতর্কে সুর নরম কামিন্সের, “আমার মনে হয় প্রস্তুতি যথেষ্ট ছিল। বোলাররা শুরু থেকেই ভালো করেছে। তবে আমরা আমাদের সেরা ক্রিকেটটা খেলতে পারিনি।”
এখন নজর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের দিকে। ওই সিরিজ দিয়েই শুরু হতে যাচ্ছে নতুন বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পথচলা। সেটি শুধু একটি সফর নয়, বরং হতে পারে অস্ট্রেলিয়ান টেস্ট ক্রিকেটের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সূচনা।
লর্ডসের হাওয়া হয়তো কেবল একটি ট্রফি কেড়ে নেয়নি, বরং অস্ট্রেলিয়ার ভবিষ্যৎ দিকচিহ্নকেই করে দিয়েছে অস্পষ্ট।
