টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে ইতিহাস গড়ে বিশ্বজয় দক্ষিণ আফ্রিকার


দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ক্রিকেটের রাজমুকুট উঠল দক্ষিণ আফ্রিকার শিরোপায়। বহুদিন ধরে ‘চোকার্স’ অপবাদ ঘোচাতে চাওয়া দলটি এবার আর ব্যর্থতার গল্প লেখেনি—বরং লর্ডসের ঐতিহাসিক মঞ্চে নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে গর্বিত অধ্যায় রচনা করেছে তারা।
বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে তারা হারিয়েছে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে, তাও ৫ উইকেটের মতো স্পষ্ট ব্যবধানে। শক্ত প্রতিপক্ষ, চাপের ম্যাচ, আর ইতিহাসের ওজন—সব কিছুকে ছাপিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা দেখিয়ে দিয়েছে, তাদের হার না মানা মানসিকতাই নতুন যুগের সূচক।
এই জয়ে কেবল একটি শিরোপা নয়, দক্ষিণ আফ্রিকা জিতেছে আত্মবিশ্বাস, সম্মান ও ক্রিকেট বিশ্বে নতুন করে নিজেদের জায়গা। অতীতের দুঃখগাথা, ১৯৯৯ বিশ্বকাপের হতাশা কিংবা বারবার সেমিফাইনালে থেমে যাওয়ার স্মৃতি—সবই আজ অতীত। লর্ডসের আকাশে আজ শুধুই প্রোটিয়াদের বিজয়োল্লাস।
এই শিরোপা হয়তো শুধু একটি ট্রফি নয়, বরং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বহন করে চলা এক স্বপ্নের বাস্তব রূপ। এখন দক্ষিণ আফ্রিকা শুধু ‘চোকার্স’ তকমা ঘোচায়নি, বরং নিজেরা প্রমাণ করেছে—তারা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্যই খেলেছে, এবং জিতেছে।
প্রথম ইনিংসে রাবাদার আগুন
প্রথমে ব্যাট করতে নামা অস্ট্রেলিয়া শুরু থেকেই চাপে পড়ে যায় প্রোটিয়া পেস আক্রমণের সামনে। উসমান খাজা ২০ বল খেলে শূন্য রানে ফিরে গেলে দলীয় ভিত দুর্বল হয়ে পড়ে। যদিও স্টিভ স্মিথ একপ্রান্ত আগলে রাখার চেষ্টা করেন, তবুও তার ইনিংস থামে ৬৬ রানে। অন্যদিকে, ক্যাগিসো রাবাদা ৫ উইকেট শিকার করে অজি ব্যাটিংয়ে ধস নামান। ইয়ানসেন নেন ৩ উইকেট। ফলে প্রথম ইনিংসে ২১২ রানে গুটিয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া।
কামিন্সের একার প্রতিরোধে ভাঙে প্রোটিয়া ইনিংস
দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং লাইনআপ এরপর প্যাট কামিন্সের একক নৈপুণ্যে ধসে পড়ে। মাত্র ২৮ রানে ৬ উইকেট নিয়ে একাই বাউন্ডারি আঁটকে ধরেন তিনি। প্রোটিয়াদের হয়ে সামান্য প্রতিরোধ আসে বেডিংহ্যাম (৪৫) ও বাভুমা (৩৬)-এর ব্যাটে। ইনিংস থামে ১৩৮ রানে।
দ্বিতীয় ইনিংসে বোলারদের প্রত্যাবর্তন
দ্বিতীয় ইনিংসে আবারও দক্ষিণ আফ্রিকার বোলাররা প্রভাব বিস্তার করেন। লুঙ্গি এনগিদি ও রাবাদার যৌথ আক্রমণে ২০৭ রানেই থামে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস। মিচেল স্টার্ক অপরাজিত থাকেন ৫৮ রানে, তবে দলের সংগ্রহ বাড়াতে পারেননি। দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ২৮২ রান।
মার্করামের মহাকাব্যিক ইনিংস
চতুর্থ ইনিংসে, যেখানে সব সময় দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাস ঘেমে উঠেছে, সেখানেই এবার উদিত হলো এক নতুন নায়ক—আইডেন মার্করাম। চাপের মুখে ২০৭ বল খেলে ১৩৬ রানের অসাধারণ ইনিংস খেলে দলকে নেতৃত্ব দেন জয়ের পথে। তার সাথে ছিলেন অধিনায়ক বাভুমা, যিনি ৬৬ রানের ইনিংস খেলে দৃঢ়তা ও স্থিরতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
তাদের ১৪৭ রানের জুটিই ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। শেষদিকে বেডিংহ্যাম ও ভেরেইনের সংযমী ব্যাটিংয়ে ৫ উইকেট হাতে রেখেই জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছায় দক্ষিণ আফ্রিকা।
এক ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ
জয়ের মুহূর্তে লর্ডসের ড্রেসিংরুম থেকে ভেসে আসে উল্লাস, কান্না ও গর্বের একসাথে মিশে যাওয়া অনুভব। বাভুমার চোখে জল, রাবাদার চিৎকার আর মার্করামের শূন্যদৃষ্টি—সবকিছুই জানান দেয়, এই জয়ের পেছনে ছিল বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা বেদনার গল্প।
শেষ কথা
এই জয় শুধু একটি ট্রফি নয়, এটি এক দেশের মানসিক মুক্তি। যে দলটা বারবার হোঁচট খেয়েছে, আজ তাদের ইতিহাস নতুনভাবে লেখা হলো। দক্ষিণ আফ্রিকা প্রমাণ করেছে—তারা আর আগের মতো নয়। তারা এখন সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন।
