ষড়যন্ত্রের ছায়া রাষ্ট্রযন্ত্রে: প্রশ্ন উঠবেই, চাপা দেওয়া যাবে না


একটি কনভেনশন সেন্টারে ৪০০ লোক দিনের পর দিন প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ ঘোষিত ক্যাডাররা রাজনৈতিক সহিংসতার পরিকল্পনায় ব্যস্ত, আর আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ বাহিনী, প্রশাসন, সবাই নির্বিকার?
এটা কি নিছক গাফিলতি? নাকি গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রেই কোনো ছিদ্র তৈরি হয়ে গেছে, যার ভেতর দিয়ে নৈরাজ্যপ্রিয় শক্তিগুলো নির্বিঘ্নে প্রবেশ করছে?
এই প্রশ্নগুলো আর সাধারণ রাজনৈতিক তর্কে আটকে রাখা যাবে না। কারণ ভাটারা কনভেনশন সেন্টারে শেখ হাসিনাকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে যেভাবে প্রশিক্ষণ ও ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা করা হয়েছে, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বাস্তবতায় এক ভয়ংকর বার্তা বহন করে। রাষ্ট্রের ভেতরেই আজ রাষ্ট্রবিরোধী প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।
ঘটনার পেছনে নাম এসেছে একজন মেজর ও একজন এএসপির। রাষ্ট্রের দুই গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় কর্মকর্তারা কীভাবে এমন ষড়যন্ত্রের অংশ হয়ে ওঠেন, তা কেবল ব্যক্তিগত বিচ্যুতি বলে চালানো যাবে না। এটা একটা সিস্টেমিক প্রবণতার আলামত, যেখানে দলীয় আনুগত্য পেশাগত দায়িত্ববোধকে গ্রাস করে ফেলেছে। এই ফাঁক দিয়ে কখন, কার নেতৃত্বে, কাদের সহায়তায় দেশে ফের ‘পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা’ পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা হবে, তা আগেভাগেই ঠেকাতে না পারলে এই ছিদ্র একসময় ধস নামাবে।
ঢাকা মহানগরে যেখানে প্রতিটি থানায় আছে নির্দিষ্ট গোয়েন্দা টিম, যেখানে প্রতিটি কনভেনশন সেন্টারের কার্যক্রম নজরদারির মধ্যে থাকার কথা, সেখানে দিনের পর দিন একাধিক প্রশিক্ষণ কীভাবে গোপন থাকে? এটা কি গোয়েন্দা ব্যর্থতা, নাকি 'উর্ধ্বতন সম্মতিতে' জেনে-শুনেই না জানার ভান?
রাষ্ট্রের ভেতরেই যদি একাংশ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মৌন সমর্থন দিয়ে যায়, তাহলে নিরাপত্তার শ্লোগান আর তদন্তের আশ্বাস, এগুলো একধরনের রাষ্ট্রীয় কসমেটিক্স ছাড়া কিছু নয়।
এই ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রে রয়েছে এক পুরনো নাম, শেখ হাসিনা। ভারতে আশ্রয় নেওয়া ফ্যাসিস্ট নেত্রীকে ঘিরে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা কীভাবে সম্ভব? তাকে কে ফিরিয়ে আনবে? কী রাজনৈতিক কাঠামোয়? এসব প্রশ্নের উত্তর সরকার কিংবা প্রশাসনের কাছ থেকে নেই। কিন্তু প্রশ্ন একটাই, যদি শেখ হাসিনার ‘পুনর্বাসন’ এখনো কিছু গোষ্ঠীর রাজনৈতিক এজেন্ডা হয়ে থাকে, তাহলে তারা কোথা থেকে নির্দেশ পাচ্ছে? কোথা থেকে সাহস পাচ্ছে?
এখন আগস্ট মাস, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি রক্তাক্ত স্মৃতি। সেই আগস্টেই যদি এক দল শেখ হাসিনাকে ফেরাতে চায়, আরেক দল 'ফ্যাসিবাদবিরোধী অভিযান' চালায়, তবে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়?
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো, রাষ্ট্রের ভেতর কোনো রাজনৈতিক পক্ষ যেন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ব্যবহার করে ক্ষমতায় ফেরার চক্রান্ত করতে না পারে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, প্রশাসন, গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি অংশ হয় দায়িত্বে শৈথিল্য দেখিয়েছে, নয়তো সচেতনভাবে চোখ বুজে থেকেছে। তাদের উদ্দেশ্য যা-ই হোক, ফলাফল একই, রাষ্ট্র আজ প্রশ্নবিদ্ধ।
সর্বপরি, একটা রাষ্ট্রকে ধ্বংস করতে শত্রুর দরকার হয় না, ভেতরের সুবিধাভোগী দালালই যথেষ্ট। ভাটারার কনভেনশন হল থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত চলা এই নীলনকশা প্রমাণ করে, রাষ্ট্রের ভেতরে আজও এমন শক্তি সক্রিয়, যারা আবারও পুরনো শাসককে ফেরাতে চায়। প্রশ্ন হচ্ছে, এই রাষ্ট্র কি তা হতে দেবে? নাকি এখনই নিজের ভিত রক্ষা করবে?
