রবিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৫
Natun Kagoj

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে জাল সনদের অভিযোগ প্রমাণিত, তথ্য গোপন করে পদোন্নতির তদবির

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে জাল সনদের অভিযোগ প্রমাণিত, তথ্য গোপন করে পদোন্নতির তদবির
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে সেকশন অফিসার পদে লোক নিয়োগের জন্য ১৯৯৫ সালে ৫ ডিসেম্বর পত্রিকায় নিয়োগ প্রচার করা হয়। সেকশন অফিসার পদে নিয়োগে ডিগ্রি পাসসহ ৪ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। 

আবদুল আজিজ নামে এক ব্যক্তি ১৯৯২ সালের ১ মার্চ থেকে ১৯৯৬ সালের ১ মার্চ পর্যন্ত কানায় কানায় ৪ বছর দেখিয়ে এলজিইডি অফিসের জাল অভিজ্ঞতা সনদ তৈরি করে সেকশন অফিসার পদে নিয়োগ লাভ করে।এদিকে আবদুল মালেক কর্তৃক আজিজের সনদ জালিয়াতির বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর এক হাজার টাকা ফি দিয়ে আবদুল আজিজ, সেকশন অফিসার-এর বিরুদ্ধে ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ জালিয়াতির অভিযোগ দাখিল করে।

অভিযোগ পেয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সাবেক সচিব প্রফেসর নুরুল হুদার স্বাক্ষরে প্রফেসর সুচারু বিকাশ বড়ুয়া, উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রামকে আহ্বায়ক ও মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রাম এবং এনামুল হক খন্দকার, উপ-বিদ্যালয় পরিদর্শককে সদস্য করে ০৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেন ১৪/০২/২০১০ তারিখে। গঠিত কমিটি ০৬/০৪/২০১০ তারিখে দাখিলকৃত প্রতিবেদনে উল্লেখ করে বিগত ০৫/১০/২০০৯ তারিখে জনাব আবদুল মালেক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, চট্টগ্রাম-এর মাননীয় চেয়ারম্যান বরাবরে ডাকযোগে প্রেরিত এক পত্রের মাধ্যমে অভিযোগ করেন যে, মোহাম্মদ আবদুল আজিজ, সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে ০১/০৩/১৯৯২ইং হতে ০১/০৩/১৯৯৬ইং পর্যন্ত এলজিইডি অফিসে দৈনিক ভিত্তিক অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন মর্মে ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ প্রদান করে সেকশন অফিসার পদে নিয়োগ লাভ করেন। 

এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে গঠিত তদন্ত কমিটি তদন্ত করে প্রাপ্ত তথ্যসমূহ উপস্থাপন করেন: এলজিইডি, চট্টগ্রাম অফিস থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা সনদ যথার্থভাবে যাচাইয়ের জন্য তদন্ত কমিটি ০৩/০৩/২০১০ তারিখে নির্বাহী প্রকৌশলী, এলজিইডি, চট্টগ্রাম বরাবরে সরেজমিনে তদন্তের জন্য পত্র প্রেরণ করেন। সে মোতাবেক ১৪/০৩/২০১০ তারিখ তদন্ত কমিটির আহ্বায়কসহ সকল সদস্য এলজিইডি, চট্টগ্রাম অফিসে উপস্থিত হন। এলজিইডি, চট্টগ্রাম-এর নির্বাহী প্রকৌশলী বিষয়টি সহকারী প্রকৌশলী  আনিছুর রহমানকে দায়িত্ব দেন। সহকারী প্রকৌশলী  আনিছুর রহমান তদন্তের বিষয়ে মোতাবেক মোহাম্মদ আবদুল আজিজ, সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক-এর এলজিইডি অফিসে চাকরির মেয়াদকাল, চাকরি থেকে অব্যাহতিপত্র যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আবেদনের কোন কিছুই দেখাতে সক্ষম হয়নি।


সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, আবদুল আজিজকে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিপরীতে কোন প্রমাণাদি আছে কি না তা তদন্ত কমিটির নিকট উপস্থাপনের জন্য গত ২০১০ সালের ২৪ মার্চ  পত্র প্রেরণ করা হলে তিনি ২০১০ সালের ৩১ মার্চ  কমিটির সমুখে উপস্থিত হন। এতে মোহাম্মদ আবদুল আজিজ এলজিইডি অফিসের চাকরির নিয়োগপত্র, যোগদানপত্র, চাকরি থেকে অব্যাহতিপত্র যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আবেদনের কপি উপস্থাপন করতে পারেনি।


এলজিইডি, চট্টগ্রাম কর্তৃপক্ষ মোহাম্মদ আবদুল আজিজ-এর চাকরির অভিজ্ঞতা সনদ প্রদানের স্বপক্ষে কোন তথ্য প্রদান করতে পারেনি। আবদুল আজিজও এর স্বপক্ষে কোন তথ্য প্রদান করতে পারেনি। তদন্ত কমিটি কর্তৃক দাখিলকৃত প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, আবদুল আজিজ অভিজ্ঞতা সনদ জাল করে সেকশন অফিসার পদে নিয়োগ লাভ করেন। 

গত ২০১০ সালের ৬ এপ্রিল তদন্ত কমিটি কর্তৃক দাখিল প্রতিবেদনে সনদ জালের অভিযোগ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হওয়ার পরও বোর্ড কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালের ১৫ মে আবদুল আজিজকে অফিসে চাকরির প্রমাণপত্র দাখিলের জন্য ইস্যু করা হয়। 

পত্রে উল্লেখ করেন যে, আপনার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্তের জন্য গঠিত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, চট্টগ্রাম হতে আপনি ১৯৯২ সালের ১লা মার্চ  থেকে ১৯৯৬ সালের ২ মার্চ  পর্যন্ত ৪ বছর চাকরি দাবি করেন। উক্ত অফিসের কোন প্রমাণ বা রেকর্ডপত্র তদন্ত কমিটির কাজে প্রদর্শন করতে পারেনি। যদি আপনার দাবি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে গ্রহণযোগ্য যে কোন দালিলিক প্রমাণ যেমন চাকরির নিয়োগপত্র, অব্যাহতিপত্র, মজুরি/বেতন গ্রহণের প্রমাণপত্র ইত্যাদি ৩ কর্মদিবসের মধ্যে চেয়ারম্যান বরাবরে দাখিল করার জন্য অনুরোধ করা হয়। অন্যথায় নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া হবে যে, আপনি এলজিইডি অফিস, চট্টগ্রামে কখনো চাকরি করেননি এবং চাকরি না করেই আপনি কথিত অভিজ্ঞতা সনদ সংগহ করে বোর্ড কর্তৃপক্ষের সাথে প্রতারণা করেছেন।

আজিজ কোন দালিলিক প্রমাণ দাখিল করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হওয়ায় তার অসত্য তথ্য প্রদান, প্রতারণা ও অসদাচরণের দায়ে স্মারক নং-২০০৪(৬), তারিখ: ২০/০৬/২০১০ মূলে আজিজের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা ১৯৮৫-এর বিধি-৩(বি) ও (ডি) অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুষ্ঠুভাবে বিভাগীয় মামলা পরিচালনার স্বার্থে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরবর্তীতে জালিয়াতকারী আজিজের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্মারক নং-২১৩০(৪), তারিখ: ১২/০৮/২০১০ মূলে মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন উপ-পরিচালককে আহ্বায়ক করে ০৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক ও সনদ জালিয়াতকারী আজিজের স্ত্রীর আত্মীয়ের বাড়ি রাঙ্গুনিয়া, আজিজের স্ত্রীর বাড়িও রাঙ্গুনিয়া, সেই সুযোগে কমিটির আহ্বায়কদের সাথে আঁতাতের মাধ্যমে সুকৌশলে কমিটি তদন্তের গভীরে না গিয়ে মানবিক কারণের কথা বলে তাড়াতাড়ি করে কমিটির এখতিয়ার বহির্ভূত প্রতিবেদন দাখিল করেন। 

প্রতিবেদনটি নথিতে উপস্থাপন করলে বোর্ড কর্তৃপক্ষ নথিতে এই মর্মে অনুমোদন দেন যে, বিভাগীয় তদন্ত কমিটি তদন্তের গভীরে না গিয়ে মানবিক দিক বিবেচনায় এনেছিল। বিষয়টি অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন। বিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখিত মানবিক দিক বিবেচনার জন্য প্রস্তাব পেশ করায় আবদুল আজিজের সাময়িক বরখাস্ত আদেশ আপাতত প্রত্যাহারের নির্দেশ ছিল বোর্ড কর্তৃপক্ষের, ফাইল নোটে আছে। শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে গুঞ্জন সৃষ্টি হয়েছে, আপাতত প্রত্যাহার করা সাময়িক বরখাস্ত আদেশ কত দিন, কত মাস, কত বছর থাকবে কোন বিধিতে আছে জালিয়াতকারী প্রমাণিত না হওয়ার পর মানবিক কারণে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ আপাতত প্রত্যাহারের নিয়ম? শুধু তাই নয়, সাময়িক বরখাস্ত আদেশ আপাতত প্রত্যাহার করার পর আজিজ তথ্য গোপন করে সুকৌশলে টাইম স্কেলের জন্য আবেদন করেন। টাইম স্কেল কমিটির আহ্বায়ক ঠিক সেই ব্যক্তি, যাকে আহ্বায়ক করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা পরিচালনার জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তার দ্বারা আবারও টাকা দিয়ে আজিজের পক্ষে মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়ে টাইম স্কেল প্রদানে সহায়তা করেন। আজিজ আওয়ামী লীগ বলে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার দাপটে তখন তার গোপনীয় প্রতিবেদন যাচাই করা হয়নি। তখনকার গোপনীয় প্রতিবেদন যাচাই করলে প্রমাণ মিলবে। অবৈধ পন্থায় আজিজকে টাইম স্কেল প্রদান করায় বোর্ডের প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান। এত অপরাধের পরও দুর্নীতিবাজ, সনদ জালিয়াতকারী আজিজের কোন শান্তি না হওয়ায় ০২/১২/২০১৪ তারিখে সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও সচিবের সাথে উদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করে, যা চাকরির পরিপন্থী বলে তাকে ০৩/১২/২০১৪ তারিখে ব্যাখ্যা তলব করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বলেন, কোন বিধান আছে কি না জানি না, চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার পর সাময়িক বরখাস্ত আপাতত প্রত্যাহারে পদোন্নতি, সিলেকশন গ্রেড, টাইম স্কেল নিতে পারে। তার জালিয়াতির বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনে জানানো হলে, মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে দুদক যাতে তদন্ত না করে সেভাবে আজিজ দুদককে ম্যানেজ করে। 

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেকশন অফিসার বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্ষমতা দেখিয়ে ফ্যাসিস্ট আজিজ সনদ জালিয়াতি, সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পরিচয়ে শিক্ষার্থীদের পাশ করিয়ে দেওয়ার নামে টাকা গ্রহণ, টেন্ডার করে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথের ছেলের ফলাফল জালিয়াতি, নারায়ণ গংদের সাথে ১৮ কোটি টাকার খাতা ক্রয়, ঘুষ নেওয়াসহ বিভিন্ন অনৈতিক কাজে আজিজ জড়িত। বর্তমান যে অস্থির হয়ে আছে সকল তথ্য গোপন করে পদোন্নতি পেতে। তা যদি হয় চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে বলে কর্মচারীদের মধ্যে গুঞ্জন রয়েছে।


গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন