রবিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৫
Natun Kagoj

স্ট্রং রুম থেকে অস্ত্র চুরি, বিমানবন্দর নিরাপত্তা দুর্বলতার আশঙ্কা

স্ট্রং রুম থেকে অস্ত্র চুরি, বিমানবন্দর নিরাপত্তা দুর্বলতার আশঙ্কা
ছবি: সংগৃহীত
গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কয়েক দিন পর স্ট্রং রুমের ভল্ট থেকে সাতটি আগ্নেয়াস্ত্র চুরি হয়েছে। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি এমন এই ভল্টে থাকা অস্ত্র চুরির ঘটনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতা উঠে এসেছে।

বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, চুরির সময় স্ট্রং রুমের নিরাপত্তা কড়া ছিল, তবে কে বা কারা এই চুরি ঘটিয়েছে তা এখনও নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।
প্রাথমিকভাবে পুলিশ ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ফরেনসিক তদন্ত শুরু করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন ঘটনা বিমানবন্দর নিরাপত্তা ও কার্গো পরিচালনার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। চুরি হওয়া অস্ত্রগুলো যাতে অবৈধ কাজে ব্যবহৃত না হয়, সেই দিকে সতর্ক থাকার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

গত রোববার (২ নভেম্বর) নিয়মিত পরিদর্শনের সময় এ অস্ত্র খোয়া যাওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ে, যা জানাজানি হতেই বিমানবন্দরজুড়ে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে।

চুরি হওয়া অস্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এম-৪ কারবাইন রাইফেল ও ব্রাজিলের টরাস কোম্পানির তৈরি সেমি-অটোমেটিক পিস্তল। তবে কোন অস্ত্রের সংখ্যা কত ছিল তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

বিমানবন্দর থানায় এ ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশ সদর দপ্তর ও সিআইডিকেও বিষয়টি জানানো হয়েছে।

অগ্নিকাণ্ড ও স্ট্রং রুমের পটভূমি

গত ১৮ অক্টোবর শাহজালাল বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। প্রায় ১৭ ঘণ্টা ধরে চলা আগুনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, যেখানে ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা।

তবে আগুনে কিছুটা তাপ লাগলেও কমপ্লেক্সের স্ট্রং রুম ও এর ভল্টগুলো প্রায় অক্ষত ছিল। আগুন নেভার পর বিভিন্ন সংস্থার উপস্থিতিতে স্ট্রং রুমটি সিলগালা করা হয়।

বিমানবন্দরের কর্মকর্তাদের মতে, স্ট্রং রুমে মূল্যবান আমদানির কাগজপত্র, শুল্ক নথি, বাণিজ্যিক দলিল, সোনা, হীরা ও বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র সংরক্ষিত থাকে। এসব বের করতে হলে একাধিক সংস্থার কর্মকর্তার অনুমোদন প্রয়োজন হয়।

প্রথম পরিদর্শন ও অস্ত্রের অবস্থা

২৪ অক্টোবর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের নিরাপত্তা বিভাগ, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) এবং একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা স্ট্রং রুম পরিদর্শনে যান। তারা দেখতে পান, অস্ত্র থাকা ভল্টের লক খোলা এবং ট্রাংক ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে। ওই সময় ২১টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। যার মধ্যে তিনটি আংশিক পোড়া এবং ১৮টি সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় ছিল। এরপর ভল্টটি মেরামত করে পুনরায় সিলগালা করা হয়।

এই অস্ত্রগুলোর মধ্যে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এম-৪ কারবাইন রাইফেল এবং ব্রাজিলের টরাস কোম্পানির পিস্তল। যা সাধারণত পুলিশের স্পেশাল উইপনস অ্যান্ড ট্যাকটিকস (সোয়াট) ইউনিট ব্যবহার করে থাকে। এম-৪ কারবাইন ৫.৫৬ মিলিমিটার ক্যালিবারের গ্যাসচালিত কারবাইন, যা যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে বহুল ব্যবহৃত।

দ্বিতীয় পরিদর্শনে চুরি ধরা পড়ে

দ্বিতীয় দফায় রোববার (২ নভেম্বর) বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, বেবিচক এবং গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা পুনরায় স্ট্রং রুম পরিদর্শনে গেলে দেখা যায়, ভল্টের লক ও ট্রাংক আবারও ভাঙা। অস্ত্র মেলাতে গিয়ে দেখা যায় ২১টির মধ্যে ৭টি আগ্নেয়াস্ত্র নেই।

চুরি ঠেকাতে অবশিষ্ট ১৪টি অস্ত্র এবং অন্যান্য ভল্টে থাকা অস্ত্রগুলো সোমবার থানায় স্থানান্তর করা হয়েছে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সহকারী ব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) মো. জামাল হোসেন ২৮ অক্টোবর প্রথম জিডিটি করেন। ঘটনার পর সিআইডির ফরেনসিক দল ঘটনাস্থল থেকে তালা কাটার সরঞ্জামসহ বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে।

তদন্ত ও নিরাপত্তা ঘাটতি

বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, স্ট্রং রুমে বাংলাদেশ পুলিশের জন্য এবং বৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীদের আমদানিকৃত অস্ত্র সংরক্ষণ করা হয়। তবে আগুনে নথিপত্র পুড়ে যাওয়ায় অস্ত্রের সঠিক সংখ্যা নিশ্চিত করা যায়নি।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভল্টে সোনা ও হীরাও ছিল, কিন্তু কেবল অস্ত্র চুরি হওয়া বিষয়টি সন্দেহজনক।

অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো এখনও সচল হয়নি। ফলে ফুটেজ বিশ্লেষণ করে চোর শনাক্তের সুযোগ কম। বিমানবন্দর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাইনুল ইসলাম জানান, কয়েকজন সন্দেহভাজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে এবং তদন্ত চলছে।

এ ঘটনায় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

ঘটনার রহস্যে নতুন প্রশ্ন

নিরাপত্তা-সংবেদনশীল এই স্থানে আগ্নেয়াস্ত্র চুরি শুধু বিমানবন্দরের নিরাপত্তার জন্য নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও উদ্বেগজনক। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ ঘটনায় একাধিক সংস্থার অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতা, পর্যাপ্ত নজরদারির অভাব এবং প্রযুক্তিগত দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে।

তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সঠিকভাবে অস্ত্রগুলো কোথায় গেছে ও কারা জড়িত রয়েছে তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।


গুগল নিউজে (Google News) নতুন কাগজ’র খবর পেতে ফলো করুন

আরও পড়ুন